ছোটবেলায় বড় হারানো ছিল বটে, তবে এমন উপহারও তো কম ছিল না। সেসব উপহার ম্যাজিকের মতোই, মনের ঘরে আলো জ্বেলে দিয়েছিল বরাবর। সেই আলোতেই ছোট্ট মানিকের পথচলা শুরু। বাবাকে হারানোর ক্ষতের পাশেই ভালোবাসার ওমে ঘেরা সত্যজিতের ছেলেবেলা। বড় হয়ে সেই সফর ফিরে ফিরে দেখেছেন সত্যজিৎ রায়।
বছর আড়াই বয়সেই বাবাকে হারিয়েছিলেন সত্যজিৎ। বাবাকে হারানোর পর, হারিয়ে গিয়েছিল ছোটবেলার বাড়ি। ছোটবেলার পাড়াও। সুকুমার রায়ের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই গড়পারের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে, এমনকি উত্তর কলকাতাও ছেড়ে শহরের অন্য প্রান্তে পাড়ি জমাতে হয়েছিল শিশু মানিককে। মায়ের সঙ্গে। ভবানীপুরের বকুলবাগানে মামাবাড়িতেই তারপরে বেড়ে ওঠা সত্যজিতের।
ছোটবেলার পুঁজিতে এমন হারানোর দাগ সকলের পড়ে না। শৈশবের অমলিন দিনে এমন ক্ষত নিতান্তই বেমানান। তবু সত্যজিৎ বড় হয়ে বলেন, ‘আহা বেচারা’ কথাটা ছোটদের সম্বন্ধে বড়রাই ব্যবহার করে, ছোটরা নিজেদের বেচারা বলে ভাবে না। কেন-না তাঁর সেই ছোট্টবেলা জুড়ে হাজির রংবেরঙের স্মৃতির কোলাজ। সেখানে ধূসর দাগ পড়ে, এমন সাধ্য কী! বরং ভবানীপুরে নতুন বাড়িতে এসেই শিশু মানিকের চোখ টেনেছিল চিনেমাটির টুকরো বসানো নকশা করা মেঝে। মনে হত, না জানি কত পেয়ালা পিরিচ প্লেট ভেঙে তৈরি হয়েছে এই মেঝে! এ বাড়িতে অবশ্য আরও একটা ভালো জিনিস ছিল শিশুমনকে আকৃষ্ট করার জন্য। ‘জার্মানওয়ালা দো আনা’, ‘জাপানওয়ালা দো আনা’ হেঁকে যাওয়া ফেরিওয়ালারা তো ছিলই, আর সপ্তাহে দু-তিনদিন দেখা মিলত মিসেস উডের বাক্সওয়ালার। সেই বাক্সে থাকত মেমসাহেবের তৈরি কেক, পেস্ট্রি, প্যাটি।
খাবারদাবার নিয়ে অবশ্য আরও একটা ভারী মজার কাণ্ড ঘটেছিল মানিকের ছোটবেলায়। আজকে আমরা ফ্লোটেল নিয়ে যতই আপ্লুত হই না কেন, অতদিন আগেও কিন্তু কলকাতায় তেমন রেস্তরাঁর দেখা পাওয়া যেত। আউটরাম ঘাটে সেই বাহারের আউটরাম রেস্তরাঁ জলের উপরে ভাসত, উলটোদিকে ইডেন গার্ডেনের চারদিকে বাহারি গ্যাসের বাতি, আর বাগানের মাঝখানে ব্যান্ডস্ট্যান্ডে সন্ধ্যাবেলা বাজত গোরাদের ব্যান্ড। কাকার সঙ্গে সেখানেই একবার গিয়েছিলেন ছোট্ট মানিক, আর সেখানেই জীবনে প্রথমবার আইসক্রিম খাওয়ার সুযোগ হয়। তারপরে কী হয়েছিল শুনে নেওয়া যাক তাঁর বয়ানেই- “এই নিয়ে পর অনেকদিন ঠাট্টা শুনতে হয়েছিল; কারণ প্রথম চামচ মুখে দিয়ে দাঁত ভীষণ সিরসির করায় আমি বলেছিলাম আইসক্রিমটা একটু গরম করে দিতে।”
সেকালের সাহেবি কলকাতায় এমন নানা আকর্ষণের ছড়াছড়ি। সেসবের বৈচিত্র্যে ছোট্ট মানিকের চমকে যাওয়ারই কথা। যেমন চমক ছিল হোয়াইটঅ্যাওয়ে লেডল, যা আজকের দিনের কোনও নামীদামি শপিং মলকে টেক্কা দিতে পারত অনায়াসে। কলকাতায় প্রথম লিফট বসেছিল এখানেই। চৌরঙ্গীর সেই বিশাল দোতলা দোকানের সমস্ত দোতলাটাই বড়দিনের ক’টা দিন হয়ে যেত টয়ল্যান্ড। মায়ের সঙ্গে একবার এই দোকানে গিয়ে সত্যজিৎ দেখেছিলেন মেঝের অনেকখানি জায়গা জুড়ে পাহাড় নদী ব্রিজ টানেল সিগন্যাল স্টেশন, আর তার মধ্যেই রেললাইন দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে খেলার রেলগাড়ি। ঘর জুড়ে বেলুন, রঙিন কাগজের শিকল আর ঝালর, ফুল ফল, চিনে লন্ঠন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখ টানছে ক্রিসমাস ট্রি আর তিন মানুষ সমান বড় ফাদার ক্রিসমাস। ক্রিসমাসের উপর এমন টান ছিল বলেই আরা-তে মেজোপিসিমার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে জুন মাসেই ফাদার ক্রিসমাসকে টেনে এনেছিলেন মানিক। ছোট ভাইয়ের জন্য সান্তা ক্লজ সেজে মোজায় উপহার পুরে দিয়েছিলেন পিসতুতো দাদা।
ছোটবেলায় বড় হারানো ছিল বটে, তবে এমন উপহারও তো কম ছিল না। সেসব উপহার ম্যাজিকের মতোই, মনের ঘরে আলো জ্বেলে দিয়েছিল বরাবর। যেমন উপহার পাওয়া ম্যাজিক ল্যান্টার্ন হয়তো মানিককে মনে মনে বুঝিয়ে দিয়েছিল, বড়বেলায় কোন পথ তৈরি হয়ে উঠবে তাঁর সামনে। লেন্স-রিল-ফিল্মের খেলায় সেই আজব যন্ত্র চলন্ত ছবি ফেলত দেওয়ালের উপর। আরও ছোটবেলায় খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আসা আলোয় দেওয়াল জুড়ে রাস্তার চলচ্ছবি দেখার অভ্যাস ছিল সত্যজিতের, যাকে তিনি বলেছেন ‘বিনি পয়সার বায়স্কোপ’। আর কিশোরবেলার এই ম্যাজিক ল্যান্টার্নই হয়তো সত্যিকারের ফিল্মের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল তাঁর মনে, ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ে বলে গিয়েছেন সত্যজিৎ রায়।