মা যে আদিকালে ঠিক কী ছিলেন, কে জানে! আদিম অরণ্যে কৌম সমাজের মায়েরা কেমন ছিলেন? কৃষিভিত্তিক সমাজের মায়েরা কেমন হলেন? উদ্বাস্তু পরিবারের মায়েরা কেমন ছিলেন? পুঁজিবাদী সমাজে গৃহকর্মসহায়িকা মা-ই বা কেমন? সেই সমাজেই, ভীষণ ধনী কিন্তু রক্ষণশীল পরিবারের মায়ের কী ছবি? চাকুরিরতা বিবাহবিচ্ছিন্না, নতুন করে জীবনকে ভোগ করতে চাওয়া মায়েরাই বা কেমন হবেন? মাতৃদিবসের আবহে ভেবে দেখলেন বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায়।
পাঠ: চৈতালী বক্সী
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
“মা, জামা ঠিক করে বোসো।”
স্মিতার পাশে বসে অঙ্ক করতে করতে চোদ্দো বছরের পুপলু বলে উঠল। সিদ্ধ হতে থাকা গরমে, সদ্য ভাড়া নেওয়া পেন্টহাউসের আড়াই বেডরুমের ফ্ল্যাটের বড় ঘরটায় একটা হালকা ম্যাক্সি ড্রেস পরে ল্যাপটপে কর্মরতা স্মিতা, অনবধানে হাঁটুর একটু উপরে উঠে যাওয়া জামাটা টেনে নিতে নিতে হেসে ফেলল। ত্রিপুরার সরকারি আর্ট কলেজের পুজোয় সরস্বতী ঠাকুরের প্রতিমার শাড়িবিহীনতা নিয়ে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, বজরং দল, আর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ইদানীং বেজায় শোরগোল তুলেছে। ব্যাপারটার রাজনৈতিক দিকটা নিয়ে স্মিতা এক্ষুনি একটা প্রবন্ধ লিখছিল। তবুও ওর মাথায় বিদ্যুতের মতো খেলে গেল, মায়ের পোশাক নিয়ে সন্তানের অস্বস্তির অংশটা। যা মূলত অনাবৃত শরীর দেখে তৈরি মানুষের মস্তিষ্কের জৈবিক যৌন প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে তার সামাজিক শিক্ষা, সংস্কার, এবং উচিত-অনুচিত বোধের ঘাত-প্রতিঘাতসঞ্জাত অনুভূতির প্রকাশ। যার সঙ্গে যোগ হয়ে যায় পোশাকের দৈর্ঘ্য আর যৌনতা নিয়ে গড়ে ওঠা তৎকালীন সামাজিক নিয়ম। মা কিছুদিন আগে অব্দি যাহা ছিলেন, তার সঙ্গে মা আজ যাহা হইয়াছেন, তার সংঘাত। কিছু ছেলে মেয়ে, যারা আস্তিক, আর যারা সরস্বতীকে কেবল জ্ঞানের দেবী হিসেবে নয়, দেবী-মা হিসেবে দেখে, তাদের হয়তো সত্যিই একটা অরাজনৈতিক অস্বস্তি হয় প্রতিমার মাতৃমূর্তির সুপুষ্ট বুক অনাবৃত রূপে দেখা গেলে। তা সে যতই “জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে” আউড়ে দেবীর বসনহীন বুকের ওকালতি করো না কেন! পান্নালাল ভট্টাচার্যের কণ্ঠে শ্যামাসঙ্গীতে শোনা যাবেই, “বসন পরো মা, বসন পরো মা”।
উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের আধুনিকা নিশা একটা ব্যাপার দেখেশুনে আজকাল খুব মজা পায়। তাদের সুখী পরিবারের বর্তমান সদস্য চারজন। সে, তার স্বামী অনিমেষ, শিশুকন্যা মিনি, আর শাশুড়ি অমলা। অমলা দেবী সারাজীবন মফস্সল শহরে নিম্নবিত্ত পরিবারে কাটিয়ে থাকলেও, তাঁর মনটা ভারি খোলামেলা। সারাজীবন নানানভাবে বঞ্চিত হয়েও, সুখী পুত্রবধূকে হিংসে না করে তিনি বেশ ভালোইবাসেন। আজকাল অমলা দেবী খুব বেড়াতে চান। মায়ের সুখসুবিধা নিয়ে সতত সচেতন অনিমেষ কিন্তু মায়ের বেড়াবার জায়গা ঠিক করার সময় মূলত নানান তীর্থস্থানই খোঁজে। অমলা দেবী ধার্মিক বটেন। তবে ইদানীং তিনি ফাটা জিন্স আর ক্রপ টপ পরিহিতা চাকুরে বউমা নিশার সঙ্গে মাঝে মাঝেই এটা-ওটা কেনার অজুহাতে গার্লস আউটিং খোঁজেন। কোনও একটা কাফেতে বা শপিং মলে বসে পুত্রবধূর সঙ্গে কফি, কাটলেট, খাওয়া ইত্যাদি শুধু নয়, সামান্য সুরাযুক্ত ব্রিজারে চুমুক দিয়ে, ইতিউতি তাকিয়ে স্ট্রবেরি গন্ধের হুঁকো পর্যন্ত টেনে ফেলেছেন অমলা। ছেলের সঙ্গে বেরিয়ে কালীঘাট, পুরীর জগন্নাথ বা তিরুপতি দর্শনে তাঁর আজকাল আর তত রুচি নেই। কিন্তু অন্য সব বিষয়ে ভীষণ আধুনিক অনিমেষ ভাবতেই পারে না যে মায়েদের ধর্মকর্মের বাইরেও কোন বিনোদনের তেমন প্রয়োজন থাকতে পারে। তাই শাশুড়ি-বউমার গার্লস আউটিংয়ের খুঁটিনাটি তাকে বলা বারণ।
ফেসবুকে তুহিনবাবুর দারুণ নামডাক। ভদ্রলোক বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা নিয়ে, একটি বেসরকারি সংস্থায় বিরাট মাইনের চাকরি করতেন। তুখোড় রম্যরচনা আর ব্যঙ্গকৌতুক লেখেন। পড়লেই কুলকুলিয়ে হাসি পায়। তবে তাঁর মার স্মৃতি নিয়ে যখন তিনি লেখেন, তখন অনেক পুরুষই খুব নস্ট্যালজিক হয়ে পড়েন। গ্রামের দরিদ্র স্কুলশিক্ষকের স্ত্রী কীভাবে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে সংসার চালাতেন, কীভাবে ছেঁড়া শাড়ি সেলাই করে পরতেন, আর সবজির খোসাটুকুও না ফেলে ছেঁচকি বানিয়ে সন্তানদের পরিবেশন করতেন, এইসব লিখতে লিখতে তুহিনবাবুর চোখে জল চলে আসে। তাঁর স্ত্রীর চুলে বয়কাট, মাসিক হাতখরচ পঞ্চাশ হাজারের উপরে। তাঁর মেয়ে ফটাফট ইংরেজি বলে, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ি ছাড়া চলতে পারে না। মা-মেয়ের খুব বন্ধুত্ব। প্রথম যৌবনে এই মহিলার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া তুহিন এখন তাকে আর নিজের সন্তানের আদর্শ মায়ের জায়গায় রাখতে পারেন না। মাঝে মাঝেই সেই চিরদুঃখিনী মায়ের প্রোটোটাইপটা মনে পড়ে। কিছু পুরুষপ্রধান ফেসবুক গ্রুপে মাঝে মাঝেই আলোচনা হয়, “আমার বাবা রাত নটায় ইয়াব্বড় একটা এঁচোড় আর একরাশ চিংড়ি মাছ নিয়ে এসে মাকে বললেন, রেঁধে ফেলো। তাসের বন্ধুরা খেতে আসবে। মা সোনামুখ করে সে তো রাঁধলেনই, তার সঙ্গে সোনামুগের ডাল, ঝুরো আলুভাজা, দই ইলিশ, আর আমের চাটনিও দু’ঘণ্টায় নামিয়ে দিলেন!” কোনও কোনও ভাগ্যবান পুরুষের বাড়িতে এখনও তেমনই সব মাতৃমূর্তি পত্নীরূপে বিরাজমানা। তুহিনবাবুদের মতো স্মৃতিকাতর অভাগাদের মনটা হাহাকার করে ওঠে। কখনও কখনও, “আজকাল বাচ্চারা আর মায়েদের আঁচল পাবে না”, এমন দরদি বক্তব্যের নিচে নারীবাদী বদ মেয়েরা লিখে যায়, “মায়ের আঁচল না পাক, মায়ের পেনশন ফান্ডের টাকাটুকু তো পাবে!” তুহিনবাবুদের আপাদমাথা রাগে রি রি করে ওঠে!
বিজ্ঞানের নানান বিষয় নিয়ে পড়াশুনো করতে ভালোবাসে বারো বছরের চশমা পরা পড়ুয়া ঋষি। কিন্তু সম্প্রতি এই মিষ্টি ছেলেটা খুব মনোকষ্টে ভুগছে। মাছেদের মায়েরা যে জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা মাছকে খেয়ে ফেলে, আর মা বিড়াল যে কিছু বছর বাদে তার নিজের পেটের হুলো বেড়ালকে চিনতে না পেরে তার সঙ্গেও সন্তানপ্রসব করতে পারে, এ কথা জানার পরে তার বড় মনোকষ্ট হয়েছে। কেন যে বিড়াল বিষয়ে নানান কথা গুগল সার্চ করতে গিয়ে এসব কথা সে পড়ে ফেলল! মায়ের দিকে তাকালেই এখন তার চোখ দুটো অনির্দেশ্য অভিমানে জলে ভরে ওঠে। “যদি খোকা না হয়ে আমি হতেম তোমার টিয়ে”-জাতীয় দুর্বোধ্য অভিমান। তার মা অনীতা বুঝতেই পারে না, কী হয়েছে! একবিংশ শতাব্দীর শহুরে শিশুর মনে মায়ের যে ছবিটি শাশ্বত মনে হত, তা জীবজগতের অন্য সব প্রজাতির মায়েদের কীর্তিকলাপ দেখে কেন এমন আঘাত পেল?
স্বেচ্ছায় বিবাহবিচ্ছিন্না সুমতির সঙ্গে তার মেয়ের ছিল খুব ভাব। মানসিকভাবে অত্যাচারী বাবার থেকে উচ্চশিক্ষিত, শান্ত, মিষ্টি মানুষ মাকেই তার মেয়ে রিয়া চিরকাল বেশি আপন করে পেয়েছে। কিন্তু মন তো বালাই বটেই, শরীরও বড় বালাই! অনেক দিন রুখাসুখা থেকে, খালি চাকরি আর মেয়ে মানুষ করে ক্লান্ত সুমতি আজকাল একটা ডেটিং সাইটে যোগ দিয়েছে। সপ্তাহের যে একটা দিন রিয়া তার বাবার কাছে থাকে, সেদিন সুমতি সেজেগুজে ডেটিংয়ে যায়। রিয়া যদিও মাকে সুখী দেখতে চায়, কেন জানি না, মায়ের মাতৃত্ব বাদেও একটা আলাদা সত্তা রয়েছে, সেটা বুঝতে পেরে তার মনের মধ্যে কোথাও একটা তীব্র ব্যথার পিন ফোটে। সুমতিও কখনও কখনও তার নতুন পাওয়া বয়ফ্রেন্ডের বাড়ি থেকে সকালবেলা নিজের বাড়ি ফেরার পথে ভেবে বসে, সে হয়তো খুব একটা ভালো মা নয়।
সমাজ বদলায়। সমাজের ভালো খারাপ নিয়ম নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে করতে নতুন সব নিয়ম আসে। মা যে আদিকালে ঠিক কী ছিলেন, কে জানে! আদিম অরণ্যে কৌম সমাজের মায়েরা কেমন ছিলেন? কৃষিভিত্তিক সমাজের মায়েরা কেমন হলেন? উদ্বাস্তু পরিবারের মায়েরা কেমন ছিলেন? পুঁজিবাদী সমাজে গৃহকর্মসহায়িকা মা-ই বা কেমন? সেই সমাজেই, ভীষণ ধনী কিন্তু রক্ষণশীল পরিবারের মায়ের কী ছবি? চাকুরিরতা বিবাহবিচ্ছিন্না, নতুন করে জীবনকে ভোগ করতে চাওয়া মায়েরাই বা কেমন হবেন? কিছু কিছু ব্যাঙেদের ক্ষেত্রে যেমন মা ব্যাংরা ডিম বার করেই উধাও, আর বাবাদের দায়িত্ব ব্যাঙাচিদের পালন করা, সেই মায়েরা কি খারাপ? কোনও ব্যাঙাচি ক্ষুধার্ত আর অসুস্থ হলে যদিও তারা বাবা ব্যাংদের ডাক পেয়ে বাচ্চাদের জন্য অনিষিক্ত ডিমের খাবার রেখে যায় নিয়মিত। মা হওয়ার ঠিক রূপটা কী? কে বলতে পারে?
মায়েদের বোধহয় কোনও ধরাবাঁধা রূপ নেই। জেনেটিক বৈচিত্রের প্রয়োজনে বিষমকামী প্রাণীদের প্রজননের একটা ধরণ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে দুইটি প্রাণীর থেকে আসা দুইটি কোষের মিলনে সৃষ্টি হবে একটা নতুন কোষ, দুজনের আলাদা আলাদা বিভিন্ন গুণ যার মধ্যে প্রকট হবে। সেই নতুন কোষটিকে যে নিজের মধ্যে পালন করে, সে-ই বোধহয় জীববিদ্যার দিক দিয়ে মা। প্রাণীদের ধরন অনুযায়ী, আলাদা আলাদা রকমের লালনপালন প্রয়োজন হয়। কিছু প্রাণী জন্মেই একটু সময়ের মধ্যেই স্বাবলম্বী। কিছু প্রাণী, যেমন মানুষ, বেশ কয়েক বছর লালন পালন না পেলে বাঁচবেই না ঠিকমতো। সেইমতো, আর প্রকৃতি ও পরিবেশের অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীদের মা বাবাদের লালন পালনের দায়িত্বের ধরন বদলায়। মানুষের ক্ষেত্রে নানান আর্থসামাজিক অবস্থা, স্ত্রী পুরুষের শারীরিক শক্তির তারতম্যের নানান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, আর নারীর গর্ভে থাকা সন্তানটির পিতৃত্ব সুনিশ্চিত করার নানান জৈবিক ও সামাজিক প্রয়োজন, বিভিন্ন যুগে বাবা ও মায়ের ভূমিকাগুলোকে নানানভাবে ঠিক-ভুল ধরনে নির্ধারিত করেছে। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কায়িক শক্তির গুরুত্ব কমে আসায়, মেয়ে পুরুষের লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা ও তাদের বৈষম্য ক্রমশ অবধারিতভাবে বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে বাবা আর মায়ের ভূমিকাও। তাই মা যা ছিলেন, তার থেকে মা যা হইয়াছেন, তা অনেক ক্ষেত্রেই বেশ আলাদা। আর মা যা হইবেন, তাও আলাদা হতে বাধ্য। তবে শাড়ি পরা মা-ও মা, বারমুডা পরা মা-ও মা। মানুষের মৌলিক শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যগুলি যেহেতু একই থেকে যাবে, মানব শিশুর লালিতপালিত হওয়ার প্রয়োজন যখন একইরকম থাকবে, তখন কেবল আর্থসামাজিক ও প্রযুক্তিগত তারতম্যের উপর নির্ভর করে মায়েদের বহিরঙ্গটুকু বদলাবে। মায়েদের স্বার্থপর জিনগুলি, চিরকালই সন্তানের প্রতি গভীর মমত্ববোধ তৈরি করবে। মায়েরা চিরকালই সন্তানকে বাঁচাতে আগুনে ঝাঁপ দিতে দুবার ভাববে না, বাবাদেরই মতো। রাত্রিবেলা মায়েরা সন্তানের নাকের নিচে হাত দিয়ে দেখে আসবে শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে কি না। আর অভিমান হলে, শ্যামাসঙ্গীতের সুরে সন্তানেরা যুগে যুগে বলে উঠবে, “মা মা বলে আর ডাকব না, দিয়েছ দিতেছ কতই যাতনা”। বলবে, আর মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে আদর খাবে অনতিবিলম্বেই।