ঋতুস্রাব বা পিরিয়ডস নিয়ে আজও হাজারো ছুঁতমার্গ। অনেকেই তা ‘মেয়েলি বিষয়’ বলে উড়িয়ে দেন, বিশেষত পুরুষরা। এককালে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য নিয়ে কথাবার্তাও ছিল চিন্তার অতীত। এখন পরিস্থিতি খানিকটা হলেও বদলেছে। তবে দরকার আরও বেশি সচেতনতা এবং সতর্কতার। মহিলাদের, বিশেষত কর্মরতাদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন কলকাতা ন্যাশানাল মেডিকেল কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডা. পারভীন বানু। মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন ডে উপলক্ষে (Menstrual Hygiene Day) তিনি দিলেন বিশেষ পরামর্শ, শুনলেন শুভদীপ রায়।
ঋতুচক্র চলাকালীন রক্তপাতজনিত অস্বস্তি, রক্তপাতের পরিমাণ নিয়ে উদ্বেগ, এসব লেগেই থাকে। পাশাপাশি তলপেটে বা পায়ের যন্ত্রণা কাবু করে। সেসব সহ্য করেই কাজে বেরোতে হয়। বাড়ির যাবতীয় কাজ থেকেও রেহাই মেলে না। যার ফলে ঋতুকালের স্বাস্থ্য সচতেনতা নিয়ে তেমন চর্চা হয় না বললেই চলে। অথচ একটা আস্ত দিন রয়েছে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য সচেতনতাকে কেন্দ্র করে। মে মাসের ২৮ তারিখ সারা বিশ্বে পালিত হয় ‘মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন ডে’। বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই। তবে ঋতুকালে নিজেদের যত্ন নেওয়া এমন কঠিন কিছুও নয়। সাধারণ কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখলেই হবে। এ বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন ডা. পারভীন বানু। যিনি দীর্ঘদিন ধরেই মহিলাদের ঋতুকালীন সচেতনতা নিয়ে নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন কাজ করে চলেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর সংস্থা পিঙ্ক ফ্ল্যাগ-এর নাম উল্লেখ করতে হয়। প্রতি বছর মে মাসের ২৮ তারিখ অর্থাৎ ‘মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন ডে’ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাও করে ‘পিঙ্ক ফ্ল্যাগ’।
প্রথমেই জানা দরকার, মেন্সট্রুয়াল হাইজিনের ক্ষেত্রে কোন কোন ভুলগুলো সবচেয়ে বেশি হয়?
ডা: পারভিন এক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। প্রথমেই অপরিচ্ছন্ন কাপড়ের ব্যবহার। পরিসংখ্যান বলছে এখনও দেশের মাত্র ২২ শতাংশ মহিলা পিরিয়ডস চলাকালীন স্যানিটারি ব্যবহার করেন।। সেই হিসাবে এখনও দেশের অনেক মহিলাই ঋতুকালে কাপড় ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে ব্যবহারের পর সেই কাপড় যেন ভালভাবে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। শোকানোর সময় সেই কাপড় এমন জায়গায় মেলতে হবে, যাতে কাপড়ের উপর দিয়ে কোনও পোকামাকড় না যেতে পারে। অর্থাৎ কোনওভাবে তা অপরিচ্ছন্ন যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে ঋতুকালে কীভাবে যোনিদ্বার পরিষ্কার করা হচ্ছে সে ব্যাপারে। তবে সব ক্ষেত্রে সে সুযোগ মেলে না। বিশেষ করে কর্মরতা মহিলারা এই সমস্যার সম্মুখীন হন সবথেকে বেশি। এক্ষেত্রে ডা. পারভীন সঙ্গে অতিরিক্ত প্যাড রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। এবং ব্যবহৃত প্যাড যত্রতত্র না ফেলে কাগজে মুড়ে সঙ্গে রাখতে বলেছেন। এছাড়া মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কর্মরতা মহিলারা ঋতুকালীন অবস্থায় কিছুটা হলেও স্বস্তি বোধ করবেন।
সাধারণ কিছু সচেতনতা না মানলে নানা রোগের কথাও উল্লেখ করেছেন ডা. পারভীন। তবে সচেতনতা স্রেফ স্বাস্থ্যের নয়। পিরিয়ডস সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণাও থাকে। যেমন,
এইসময় টক বা অনেক খাবার খেতে বারণ করা হয়। সত্যিই কি ঋতুকালে এমনটা করলে শরীরে প্রভাব পড়ে?
ডা.পারভীন বলছেন, ঋতুকালীন ডায়েট বলে আলাদা কিছু হয় না। স্বাভাবিক ভাবে বাড়ির খাবার খেলেই চলবে। পাশাপাশি কোনও নির্দিষ্ট খাবার স্রেফ ঋতুকালে খাওয়া যাবে না, এমনটা নয়। বিশেষ করে টক খাওয়ায় কোনও বারণ নেই। বরং এই সময় টক জাতীয় ফল বা ভিটামিন সি শরীরের জন্য বিশেষ উপকারী। সুতরাং ঋতুকালে ডায়েট থেকে টক বাদ রাখা ভ্রান্ত ধারণা। মন চাইলে যা ইচ্ছা খাওয়া যেতেই পারে। তবে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়াই ভালো। বাইরের অতিরিক্ত তেলঝালমশলাযুক্ত খাবার এমনিতেই চিকিৎসকরা এড়িয়ে চলতে বলে। ঋতুকালেও সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে অনেকেই অতিরিক্ত রক্তপাতে বা পেটের যন্ত্রণায় বেশ কাহিল হয়ে পড়েন। সেক্ষেত্রে ব্লাড প্রেসার ঠিক রয়েছে কি না দেখা দরকার। প্রয়োজনে ডাবের জল খাওয়া যেতে পারে।
পিরিয়ডসের সময় ব্যথার বিষয়টাও অবহেলা করা যায় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই ব্যথার নাম ‘ডিসমেনোরিয়া’। সেই অবস্থায় রোজকার রুটিন মেনে কাজকর্ম করা বেশ সমস্যার হয়ে ওঠে। ফলে অনেকেই চটজলদি ভরসা রাখেন ব্যথা কমানোর রকমারি ওষুধের উপরে। কিন্তু মুশকিল হল, যেহেতু ঋতুচক্র এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছুই শরীরের প্রজননতন্ত্র ও হরমোন সিস্টেমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, ফলে তার সঙ্গে যা-ইচ্ছে-তাই করলে উলটে অন্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে ডা. পারভীন জানাচ্ছেন, বেশি ব্যথা হলে গরম সেঁক নিলে আরাম পাওয়া যায়। হট ব্যাগ বা নরম সুতির কাপড় হালকা গরম করে পেটে সেঁক দিতে পারেন। আবার হালকা গরম জলে স্নান করলে পেলভিক পেশিগুলো আলগা হয়, ফলে ব্যথা কমে যায়। ওষুধের ক্ষেত্রে ডা. পারভীন মেফিনামিক অ্যাসিড যা মেফট্যাল স্পাস নামে পরিচিত, কিংবা প্যারাসিটামল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। তবে ব্যথা হচ্ছে মানেই ওষুধ খেয়ে নেওয়া যাক, এই প্রবণতা থাকলে চলবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে খেতে হবে ওষুধ। তাও একান্ত প্রয়োজন পড়লে তবেই।
এসব ছাড়াও মেনে চলতে হবে একেবারে সহজ একটি নির্দেশ। সারা দিনে যথাযথ পরিমাণে জল খেতে হবে। যে কোনও ধরনের যন্ত্রণা বা পেশিতে টান ধরার মতো সমস্যার ক্ষেত্রে জলের কোনও বিকল্প নেই। শরীর যত আর্দ্র থাকবে, ততই নিয়ন্ত্রণে থাকবে যন্ত্রণা। পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে এই সময়ের সচেতন থাকার বিষয়গুলিও।