অভিনয়কুশলতায় ইরফান খানের জায়গা নিতে পারতেন বিক্রান্ত মাসে। অথচ ফিল্ম দুনিয়া যখন তাঁকে নিয়ে বাজি ধরছে, তখনই দৌড়ের মাঠ ছেড়ে ডানা গুটিয়ে বসতে চাইলেন তিনি। আর বিক্রান্তের এই সিদ্ধান্ত একটা কথা বুঝিয়ে দিল, অবসরের ধারণাতে বদল এসেছে। কেবল অন্যরকম কিছু করে ওঠাই নয়, নিজস্ব জীবনের কাছে ফিরে যেতে চাওয়ার বাসনাও গুরুত্বপূর্ণ।
হি রাইজেস টু কঙ্কার!
এ বছরই প্রখ্যাত ফিল্মফেয়ার পত্রিকার প্রচ্ছদে যখন বিক্রান্ত মাসের হাসিমুখ, তখন তাঁর নামের নিচে ক্যাপশনে লেখা ছিল এই কথাটিই। জয়ের নিশান ছিনিয়ে নিতেই উত্থান ছেলেটার। মোটামুটি এক দশক পেরিয়ে এসে এই বিশ্বাসে থিতু হয়েছিল ইন্ডাস্ট্রি। ফিল্মফেয়ার-এর প্রচ্ছদকে যদি আমরা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ধরে নিই, তবে বলা যায়, পরীক্ষা শেষে বিক্রান্তকে পুঁজি হিসাবেই ধরে নিয়েছিল সিনেমার আগামী পৃথিবী। অথচ এই পুরো আখ্যানে বিক্রান্ত নিজে আকস্মিক হয়ে উঠলেন প্রস্থানবিন্দু। অতর্কিত, অনেকটা যেন অনভিপ্রেতও। ৩৭ বছর বয়সে যখন খ্যাতির চাকে মধু, তখন অবসর ঘোষণা করে ফেলা সহজ কথা নয়। বিক্রান্ত তাঁর চিত্রনাট্য নির্বাচনের মতোই এখানে স্বতন্ত্র।
এই স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি প্রত্যাশিত ছিল বিক্রান্তের। সাফল্য-ব্যর্থতার গড় একটা সমীকরণ থাকে। সিনেমার ক্ষেত্রে যা নির্ধারণ করে বক্স অফিস। বিক্রান্ত সেখানে একেবারে অসফল নন। বিশেষত ওটিটি যখন নায়কপ্রধান সিস্টেমের বাইরে অভিনেতাদের স্বীকৃতির জায়গা হয়ে উঠল, বিক্রান্ত উঠে এলেন চমৎকার। ‘লুটেরা’-য় রণবীর সিংহের বন্ধু থেকে তিনি হলেন ছোট ছোট ছবি বা ওয়েব সিরিজের মুখ্য চরিত্র। ‘হাসিন দিলরুবা’ থেকে ‘মির্জাপুর’ হয়ে হালের ‘টুয়েলভথ ফেল’ বা ‘সেক্টর ৩৬’- রীতিমতো বৈচিত্র্যের সফর বিক্রান্তের। এবং প্রায় প্রতিটি চরিত্রেই তাঁর আলাদা পরত আবিষ্কার করেছেন দর্শক। বিশেষত টুয়েলভথ ফেল-এর যে লড়াকু ছেলের চরিত্র অনুপ্রেরণা জোগায়, তার পাশে ‘সেক্টর ৩৬’-এর নৃশংস হত্যাকারীকে রাখলে বোঝা যায়, বিক্রান্তের অভিনয়ের রেঞ্জ ঠিক কতখানি। দীপক দোবরিয়ালের মতো তুখোড় অভিনেতাকে প্রায় নির্বাক করিয়ে বিক্রান্ত প্রমাণ করে দিয়েছিলেন তিনি কতখানি পারঙ্গম। এই যে অধ্যবসায়, মানুষের চোখে পড়ুক তা- চাইছিলেন বিক্রান্ত।
তা খানিকটা পড়েওছিল। অভিনয়কুশলতায় ইরফান খানের জায়গা নিতে পারতেন তিনি। এ সম্ভাবনা আমদর্শকের নয়, খোদ আনন্দ এল রাইয়ের। অথচ এই সফল ফসলবিলাসী হাওয়া তেমন গায়ে মাখলেন না বিক্রান্ত।
ভবিষ্যতে তিনি কী করবেন জানা নেই। অভিনয়ে ফিরতে পারেন, নাও পারেন। তবে, বিক্রান্তের এই সিদ্ধান্ত একটা কথা বুঝিয়ে দিল, অবসরের ধারণাতে বদল এসেছে। অবসর মানেই ঠান্ডা এক কাপ চা নয়। বয়স আর জরার সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দিয়ে যে সমীকরণ খাড়া করা হয়েছে, তাকেই যেন প্রত্যাখ্যান করতে চাইছে বিক্রান্তের সিদ্ধান্ত। একজন স্রষ্টা যখন থেমে যেতে চান, হয় তিনি নিজের ভিতর একরকম সম্পৃক্ততার আভাস পাচ্ছেন; নয়তো পুনরাবৃত্তির ক্লান্তি অনুভব করছেন; সুতরাং অবসর একরকমের পারফেক্ট টাইমিং। তা শিল্পেরই সম্প্রসারণ। আর এসব যদি কিছু না-ও হয়ে থাকে, তবে নিজস্ব জীবনের কাছে ফিরে যেতে চাওয়ার বাসনাও গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের অনেক সফল মানুষই সেদিকে ঝুঁকেছেন। সাফল্য ব্যর্থতার খেলা নিরন্তর। তবে অনবরত সিঁড়ি যে ভাঙতেই হবে তার কোনও মানে নেই। যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকে, তবে পরিবারের মধ্যে, নিজের বৃত্তের মধ্যে নিজেকে খুঁজে নিতে চাওয়ার এই ভাবনা অমূলক নয়। বরং তা সফলতা নিষ্ফলতার এক গড় ধারণাকেই ভেঙে দিতে চাইছে। কেরিয়ারের সাফল্য জীবনের মাইলস্টোন বটে, চূড়ান্ত গন্তব্য নয়। প্রাপ্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে, জীবনের আকাঙ্ক্ষা আরও গাঢ় এবং গূঢ়।
বিক্রান্তের এই সিদ্ধান্ত বোধহয় আমাদের জীবনের দিকেই আরও একবার ফিরে তাকানোর কথা বলে। এই ব্যস্ততা, এই ইঁদুরদৌড়, এই ফোমো আর অ্যাটেনশন টানার অবিরত খেলা আমাদের ক্লান্ত করে। তা থেকে মুক্তির উপায় কী! বিক্রান্ত যেন বোঝালেন, কখনও জীবনের উষ্ণতাকে হাতছানি দিয়ে বলতে হয়, এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই।