পর্দায় তিনি গেয়ে উঠেছিলেন, ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া’। দৃপ্ত ভঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ইসক মে জিনা, ইসক মে মরনা… অউর হামে আব করনা ক্যায়া! ‘। আর তাতেই যেন হল ম্যাজিক। প্রেমের এমন সাহসী উচ্চারণ আর দ্বিতীয়টি নেই। ভারতীয় সিনেমা আর প্রেম- এই নিয়ে যদি কথা বলতে হয়, তবে অবধারিত ভাবে সব পথ এসে যাঁর নামে মিশে যায়, তিনি এক এবং অদ্বিতীয় মধুবালা। আর কী আশ্চর্য সিনেমায় যিনি প্রেমের রূপকথা লিখেছিলেন, তাঁর জন্মদিনটাই সারা পৃথিবী সেলিব্রেট করে প্রেমের দিন হিসাবে। আসুন আজ শুনে নিই মধুবালার গল্প।
মুঘল-এ-আজম। সেলুলয়েডে লেখা প্রেমের মহাকাব্য। কে আসিফের এ সিনেমা কেবল মাত্র চলচ্চিত্র যেন নয়, ভারতীয় সিনেমায় প্রেমের ইশতেহারই বলা যায় একে। আর সেই প্রেমের পদাবলিতে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন যিনি, তিনি মধুবালা। ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রেমের সম্রাজ্ঞী। আজ ভেবে আশ্চর্য হতে হয় যে, এই আইকনিক চরিত্রের জন্য প্রথমে তাঁর কথা ভাবাই হয়নি। এমন নয় যে, গোড়ায় ভাবা হয়েছিল যে, এই চরিত্রে তিনি প্রাণদান করতে পারবেন না। আসলে এর নেপথ্যে থেকে গিয়েছে এক বিবাদের গল্প।
আরও শুনুন: ‘হনুমান চালিশা’ গাওয়া থেকে শহর ঘোরা, চমকপ্রদ কারণে গিনেসে নাম বলিপাড়ার এই তারকাদের
ইন্ডাস্ট্রিতে মধুবালার কাজকর্মের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতেন, তাঁর বাবা আতাউলা খান সাহেব। পরিচালক কে আসিফ আগে একটি ছবির জন্য তাঁর বাবার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনি এমন এমন শর্ত রেখেছিলেন, যাতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন পরিচালক। রাগ করে সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আপনার মেয়েকে শোকেসে তুলে রেখে দিন’। এরপর যখন মুঘল-ই-আজম নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করলেন, প্রত্যাশিত ভাবেই এল না মধুবালার নাম। পরিচালক প্রথমে ভেবেছিলেন নার্গিসের কথা। কিন্তু কোনও কারণে নার্গিস এই চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হননি। এদিকে দিলীপ কুমার যে নায়ক হবেন, তা ততদিনে ঠিক হয়ে গিয়েছে। তিনি বলেছিলেন, অভিনেত্রী বিজয়লক্ষ্মীর কথা। কিন্তু কিছুতেই যেন সবকিছু মনের মতো হচ্ছিল না পরিচালকের। হয়তো বিধাতা সেদিন মুচকি হেসেছিলেন অলক্ষে। যে চরিত্র অমর করে রাখবে মধুবালাকে এবং আসিফের সৃষ্টিকে – তা মধুবালা ছাড়া আর কার কাছেই বা যেতে পারে!
আরও শুনুন: পুনর্জন্মে এই দেশের মাটিতেই আবার ফিরতে চেয়েছিলেন সুরের সরস্বতী
মনের মতো নায়িকা না পেয়ে পরিচালক কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন। অনেকেই যোগাযোগ করছিলেন। কিন্তু যা খুঁজছিলেন পরিচালক, কারোর মধ্যেই তা যেন পাচ্ছিলেন না। একদিন ঘটল এক ঘটনা। স্বয়ং মধুবালা দেখা করতে এলেন কে আসিফের সঙ্গে। গাড়ি থেকে নামলেন না। গাড়ির ভিতরই হয়ে গেল এক আশ্চর্য বৈঠক। মধুবালা কে আসিফকে জানালেন, বাবার সঙ্গে যা ঝগড়া বিবাদ ইতিমধ্যে হয়েছে তা যেন তিনি ভুলে যান। স্পষ্ট করেই জানালেন, কে আসিফের সঙ্গে তিনি কাজ করতে চান। ইতিহাসের শুরু ওই ছোট্ট বৈঠকেই। পরিচালক আর দ্বিমত পোষণ করেননি। তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন তাঁর আনারকলিকে। আর বাকিটা তো সত্যিই ইতিহাস। সেলুলয়েডে এমন প্রেমের ভাষ্য ভারতীয় চলচ্চিত্রে সত্যি বোধহয় আর লেখা হয়নি।
আরও শুনুন: স্বামী বিক্রি করে দিয়েছিল নিষিদ্ধপল্লিতে, সেই গাঙ্গুবাইয়ের জীবনই এখন সিনেমায়
সিনেমাকে যিনি প্রেমের পাঠ শিখিয়েছেন, সেই মধুবালার ব্যক্তিজীবনে প্রেম এসেছে আর গিয়েছে। দিলীপকুমারের সঙ্গে তাঁর প্রেম ছিল একসময় ইন্ডাস্ট্রিতে সবথেকে চর্চিত বিষয়। কিন্তু সেই প্রেমেও কাঁটা হন আতাউলা খান সাহেব। পরিণতি পায়নি প্রেম। পরবর্তীতে কিশোর কুমারকে বিবাহ থেকে বিচ্ছেদ- পর্দার প্রেমের রানি বাস্তবে বারবার আঘাতই পেয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তিজীবনের সেই পরত সরালে আমরা দেখতে পাই, এক অসামান্য শিল্পীকে, যিনি ইতিহাসকে জীবন্ত করে তুলতে পারেন অসামান্য দক্ষতায়। মধুবালা নামের ম্যাজিক আজও যেন প্রেমের হিল্লোল তোলে ভারতীয় দর্শকের মনে। তিনি যখন কাজ করেছেন তখন প্রেমের দিন সেলিব্রেট করার এমন চল ছিল না। তবু আশ্চর্য সমাপতনই বলতে হবে, যে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে আবিশ্ব প্রেমের দিন হিসাবে সেলিব্রেট করে, সেই দিনটিতেই জন্ম হয়েছিল মধুবালার।
আধুনিক সময়ের নিরিখে বদলে গিয়েছে প্রেমের ধরন-ধারণ। সিনেমাও ‘সিলসিলা’ পেরিয়ে খুঁজে নিচ্ছে প্রেমের ‘গেহরাঁইয়া’। তবু প্রেমের দিন এলেই আজও একখানা দৃশ্যই যেন ফুটে ওঠে সিনেপ্রেমীর চোখে। নৌশাদজির সুরে গাইছে কিন্নরকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর। আর দুনিয়ার প্রেমিকের দিকে তাকিয়ে মধুবালা বলে উঠছেন – ‘পর্দা নেহি যব কোহি খুদাসে/ বন্দোসে পরদা করোনা ক্যায়া – যব পেয়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া।’
প্রেমের এই নির্ভীক উচ্চারণেই প্রেমিকহৃদয়ে চিরকালীন অভিসারিকা হয়ে থেকে যাবেন মধুবালা।