সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-তর্কের ভিতর এসে দাঁড়ালেন শাহরুখ খান। যেমন তিনি পর্দায় এসে দাঁড়ান দু-হাত মেলে। এবার দাঁড়ালেন বাস্তবের জমিতেই। জীবনের প্রিয় মানুষকে কাছে টেনে নিলেন জীবনের অন্যতম আনন্দের মুহূর্তে। হ্যাঁ, প্রকাশ্যেই, দ্বিধাহীন। তরুণ প্রজন্ম হয়তো বলবে, এ তো সেই পিডিএ। শাহরুখ অস্ফুটে যেন বললেন, আমার ভালোবাসার কোনও জন্ম হয় না, মৃত্যুও হয় না। আর ভারতবর্ষ জানল, ভালোবাসা ছাড়া আমাদের আজও কোনও পরিত্রাণ নেই। সে ব্যক্তির কিংবা গোটা দেশের।
একটা মুহূর্ত হয়ে ওঠে আস্ত একটা প্রেমের গল্প। একটা ছবি যেন হয়ে ওঠে আস্ত এক প্রেমের পদাবলি। যে সময়ে সকলেই প্রায় জানেন যে, হাতের উপর হাত রাখা সহজ নয়। এমনকী সারা জীবন বইতে পারাও সহজ নয়। ভাঙনের ধুলোবালি এসে অহরহ ঢেকে দেয় সম্পর্কের নির্মল আলো। তখন এক যুগলের গাঢ় আলিঙ্গনেই যেন রাখা থাকে সমস্ত ক্ষতের শ্রূশুষা। আর সে যুগল যদি হন, শাহরুখ এবং গৌরী খান, তবে তো কথাই নেই! মুহূর্তটা এল আইপিএল-এর ফাইনালে কলকাতা জয়ের পর। আনন্দের মুহূর্তে গৌরীকে আলিঙ্গনে বেঁধে ফেললেন বলিবাদশা। আর সেই একটি মুহূর্তই যেন ভালোবাসার চিঠি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল গোটা ভারতবর্ষে।
আরও শুনুন: অপেক্ষার ভারতবর্ষ জানে কামব্যাকের নাম শাহরুখ খান
শাহরুখ খান তো পর্দায় রোমান্সের বাদশা। মোটামুটি দু-দশকে সেলুলয়েডে তিনি প্রেমের যে মহাকাব্য রচনা করেছেন, তার পঙক্তি ধরেই ধরেই কয়েক প্রজন্মের ভালোবাসার হাতেখড়ি। ধর্ম, রাজনীতি, দলাদলি পেরিয়ে তিনি তাই হয়ে উঠলেন ভারতবর্ষের ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ হরকরা। এখন ফিরে তাকিয়ে অনেকেই বিশ্লেষণ করে দেখেন যে, কীভাবে তিনি হয়ে উঠলেন পর্দায় রোমান্সের অদ্বিতীয় বরপুত্র। তার নানা রকম কারণ আছে। বিশেষত হিরো বা নায়ক চরিত্রে যে বদল এসেছে শাহরুখের চরিত্রদের হাত ধরে তা অনস্বীকার্য। পাশাপাশি, নায়িকা বা মহিলা চরিত্রও সেই নতুন নায়কের বিপরীতে পেয়েছে অন্য মাত্র। এমন নয় যে তা সম্পর্কের সামগ্রিক ধারণায় বিরাট অন্তর্ঘাত ঘটিয়েছে। তবে, একই সঙ্গে তা যে একটি সংস্কারের সূচনা, বিশেষত বিশ্বায়ন-উত্তর পৃথিবীর সম্পর্কের স্বপ্নই যে সেই সব চরিত্রদের মধ্যে দিয়ে ধরা দিয়েছে, এমনটাই তো বলে থাকেন বিশ্লেষকরা।
পর্দার সেই ইমেজের সঙ্গে যেন মিশে মিশে যায় তাঁর ব্যক্তিজীবন, প্রেম, সম্পর্কে বেঁধে-বেঁধে থাকার কিস্সাও। সে প্রেমের গল্প আসলে এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের ছেলে এবং উচ্চবিত্ত হিন্দু পরিবারের মেয়ের। তাঁরা একে অপরকে ভালোবেসেছিলেন। ছেলেটির প্রতিষ্ঠা ছিল না তখন। ছিল বলিউডে এসে নায়ক হওয়ার স্বপ্ন। তারপর দীর্ঘ পথচলা। কালে কালে ছেলেটি একদিন মুম্বই শাসন করেছে। হয়ে উঠেছেন গোটা ভারতবর্ষের ভালোবাসার মানুষ। পৌঁছেছেন বৈভবের মিনারে। কিন্তু কোনও কিছুই সেই ভালোবাসার বাঁধনের সুতো আলগা করতে পারেনি। গোড়ার জীবনের মতো চড়াই উতরাই বহুবারই এসেছে তাঁদের জীবনে। তবে শাহরুখ-গৌরী বরাবরই যেন বুঝিয়ে দিয়েছেন, হাতের উপর হাত রাখা তেমন কঠিন নয়। সারাজীবন বইতে পারা হয়তো সহজ নয়, তবু তেমন কঠিনও কী!
আরও শুনুন: ‘২১-এ জিতে ধোনির মুখে ছিল কেকেআর, ‘২৪-এ জিতে বাদশা বললেন সিএসকে সিএসকে…
গ্ল্যামার দুনিয়ায় সম্পর্কের ভাঙনের মুচমুচে গল্প আগেও ছিল, এখনও আছে। সেখানে ব্যতিক্রম শাহরুখ-গৌরী। তবে শুধু সিনেদুনিয়ার মানুষদের মধ্যেই নয়, সামগ্রিক ভাবেই যেন সম্পর্কে রসায়নে অনেক বদল এসেছে। নয়ের দশক যে মোহকাজল লাগিয়ে দিয়েছিল সকলের চোখে, দিন পেরিয়ে তা ক্রমাগত ক্ষয়ে গিয়েছে। সেই ক্ষয়ের ধাক্কা যেমন অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজজীবনে, তেমনই ব্যক্তিসম্পর্কেও। আমাদের মনে পড়বে, বছর কয়েক আগের এক সিনেমায় এসছিল ব্রেক-আপ পার্টি সেলিব্রেশনের দৃশ্য! তা নেহাত সিনেমার কল্পনা নয়। বরং বাস্তবেরই ছায়াপাত ছিল চিত্রনাট্যে। সময় চিরকাল এক বন্ধনীতে থেমে থাকে না। থাকেওনি। ফলত সম্পর্কের অলিগলিতে যে আলোছায়া এসেছে তা অনিবার্যই বলতে হবে। সেই সঙ্গে এসেছে বিচ্ছিন্নতা, বিষাদ, হতাশাও। একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতার চোরাগলি যেন ওঁত পেতেই বসে থাকে। এসব কি আগে ছিল না! ছিল বটে, তবে ইদানীং তার মাত্রা যে খানিক চড়া, তা দেখাই যায়। এমনকী প্রেমের ধারনাও তো কত বদলে গিয়েছে! জীবন চলছে না আর সোজা পথে। তবু জীবন চলতেই থাকে। আর সবকিছুর মধ্যেই যেন তিরতির করে বইতে থাকে বিষাদসিন্ধু।
এই সবকিছুর মধ্যেই কয়েক প্রজন্মকে প্রেমের হাতেখড়ি দেওয়া পুরোহিতটি যেন বলে উঠলেন, আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই চলে যায়নি। পলিটিক্যাল কারেক্টনেসে ঠোক্কর খেতে খেতে আমাদের স্বাভাবিকতা খানিক নষ্ট হয়েছে বইকি! হালআমলের ভাষায় যাকে পিডিএ বলা হয়, তা নিয়ে জেন জেড নিজেরাই দ্বিধাবিভক্ত। কেউ বলেন, মন্দ কী! কেউ বলেন, এর আবার দরকারই বা কী! সেই সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-তর্কের ভিতর এসে দাঁড়ালেন শাহরুখ খান। যেমন তিনি পর্দায় এসে দাঁড়ান দু-হাত মেলে। এবার দাঁড়ালেন বাস্তবের জমিতেই। জীবনের প্রিয় মানুষকে কাছে টেনে নিলেন জীবনের অন্যতম আনন্দের মুহূর্তে। হ্যাঁ, প্রকাশ্যেই, দ্বিধাহীন। তরুণ প্রজন্ম হয়তো বলবে, এ তো সেই পিডিএ। শাহরুখ অস্ফুটে যেন বললেন, আমার ভালোবাসার কোনও জন্ম হয় না, মৃত্যুও হয় না। আর ভারতবর্ষ জানল, ভালোবাসা ছাড়া আমাদের আজও কোনও পরিত্রাণ নেই। সে ব্যক্তির কিংবা গোটা দেশের।