বর্তমানের ছেঁকায় আমর্ম ক্ষতলাঞ্ছিত হয়ে যখন আমরা হাঁফিয়ে উঠি, তখন ভেসে থাকা খড়কুটোর মতোই জড়িয়ে ধরি একটি নামকে। সে নাম শাহরুখ খান। কেননা সে নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে আমাদের কৈশোর, যৌবন, প্রেম। সে নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের উন্মুক্ত অতীত, মুক্ত মন। মিশে আছে আমাদের হারিয়ে যাওয়া স্বদেশও। শাহরুখ তাই ছুতো মাত্র। আসলে তো মানুষটাকে ধরতাই করে প্রতিবার আমরা খুঁজে ফিরি নিজেকেই।
শাহরুখ খান ঠিক কী কী পারেন না? উত্তর হল, তিনি অধিকাংশ জিনিসই পারেন না। যেমন, দেশের অর্থনীতির হাল ফেরাতে পারেন না। যে সব সাম্প্রতিক বিল পাশ হলে আমাদের ঠোঁট সেলাই হয়ে যাবে, তা রুখে দিতে পারেন না। রিলে রিলে রুচি অধোগামী হয়ে দৃশ্যদূষণ প্রবল হলে শাহরুখ তার উপশম হতে পারেন না। শাহরুখ খান নোট বাতিল হলে দেশবাসীর হেনস্তা আটকাতে পারেন না। করোনার দিনকালে দেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের পায়ের পাতায় জন্ম নেওয়া যুগের ক্ষত প্রতিহত করতে পারেন না। এত বড় কথায় কী কাজ! শাহরুখ খান আমাদের পাতে বিরিয়ানি তো কোন ছাড়, ডিম-পাউরুটিও দিতে পারেন না। শাহরুখ আমাদের ব্রেক-আপ আটকাতে পারেন না। ডিপ্রেশনে বিপর্যস্ত রাতের চোখে ঘুম না এলে শাহরুখ কিছুই করতে পারেন না। শাহরুখ খান আমাদের না স্বর্গ, না স্যারিডন!
আরও শুনুন: ‘দ্বেষের দেশ’ ভোলাল ‘পাঠান’, বয়কট-ড্রাগ পেরিয়ে পর্দায় যেন ভারত-জোড়ো শাহরুখের
সত্যি বলতে, এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের জনসমর্থন নিয়ে বসে থাকা এক বিপুল ব্যর্থ মানুষের নাম শাহরুখ খান। আজীবন দু-বাহু প্রসারিত করে ভালোবাসা ফিরি করেছেন বটে। কিন্তু শাহরুখ পারেননি দেশবাসীকে ঘৃণার আবর্তে তলিয়ে যাওয়া থেকে আটকাতে। ভারতবর্ষ ঢুকে পড়েছে মন্দির বনাম মসজিদে। বর্ণবাদী বিষবৃক্ষ ভারতবর্ষকে আবার নতুন করে বেঁটে ফেলেছে গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ে। দলে দলে ভাগ হয়ে দলাদলি বেড়েছে বই কমেনি! শাহরুখ পারেননি সেসবের গতি রোধ করতে। শাহরুখ মণিপুরের মায়ের প্রবল লাঞ্ছনা রোধ করতে পারেন না। কেননা যে গোষ্ঠী সংঘর্ষের কালকূট ছড়িয়ে পড়েছে দেশের শিরা-উপশিরায়, সে বিষ ঝাড়ার বৈদ্য তিনি নন। তিনি হেরে গিয়ে জিতে যাওয়ার কথা বলে এসেছেন বটে। তবে সেই সব বাজিগরি চমককে তুচ্ছ করে ভারতবর্ষ ঢুকে পড়েছে জিতে গিয়েও হেরে যাওয়ার প্রবল আধিপত্যকামী খেলায়। অতএব শাহরুখ উত্তর-পূর্বের প্রতি অবজ্ঞার প্রতিকার হয়ে উঠতে পারেন না। এমনকী উত্তর ভারতের নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস হয়ে ওঠাও তাঁর সাধ্যের অতীত। শাহরুখ খান যেন সেই সনাতন গ্রন্থ, যার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, তবু তার পাতা উলটে দেখেননি কেউই। শাহরুখ তাই আমাদের অধোগমন আটকাতে পারেন না।
এমনকী শাহরুখ আমাদের ব্যক্তিগত বিপন্নতার মলম হয়ে উঠতেও পারেন না। সমষ্টির বোধ এখন প্রায় বিভ্রম। মানুষ যেন আর কোনও টানেই নিজেকে সমষ্টির সুতোয় বাঁধতে পারে না। তার ইউনিয়ন নেই, অতএব একে অন্যের সঙ্গে রিইউনিয়নও নেই। পড়ে আছে কেবল ব্যক্তির আধুলি। সে আধুলির গায়ে বিপন্নতার অরাজনৈতিক আলো। মানুষ যত নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, তত সে একা। তার পাশে বিশ্ব আছে ভারচুয়ালি, অথচ দূরপনেয় একাকিত্ব মুছে দেওয়ার মতো কোনও মানবিক স্পর্শের সঞ্চয় তার নেই। যৌথতাহীন মানুষ ক্রমশ অতিরিক্ত মাত্রায় রিক্ত। অর্থ নয়, অনর্থই তাকে গরিব করেছে। শাহরুখ এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি রোধ করতে পারেননি। ব্যক্তির বিপর্যয়, বিপন্নতা আর অন্তর্গত বিষাদের বিপরীতে সমষ্টির ওষুধ হয়ে ওঠা তাঁর আয়ত্তে নেই।
অথচ আশ্চর্য এই যে, তাঁকে ঘিরেই পাক খাচ্ছে দেশের কয়েক প্রজন্মের আবেগ-ভালবাসা এবং সেই হেতু অগাধ সমর্থনও। তাঁর জন্য হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ। ভালবাসার সফেন সমুদ্র বুকে নিয়েই শাহরুখের জন্য জনতার অপূর্ব জমায়েত। এই সংকটে দীর্ণ দিনে যখন আর ইউটোপিয়াতেও চোখ রাখতে ইচ্ছে করে না, তখন শাহরুখকে ঘিরেই রচিত হচ্ছে হেটারোটোপিয়া। সেই বি-কল্পক্ষেত্র যা আমাদের অবস্থানহীন অবস্থানের কথা জানান দিচ্ছে। শাহরুখ আমাদের চক্রব্যূহে ঢোকা আটকাতে পারেননি। তবু তাঁকে চক্র করেই মানুষ যেন খুঁজে নিতে চাইছে নিজস্ব পরিসর। এই যে কিছুদিন আগে বছর চারেক পরে তিনি সিনেমাতে ফিরলেন, এবং পাঠান নামে একটি সিনেমার মাধ্যমে নিজের আসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেন, এর কি কোনও ব্যাখ্যা হয়? তাত্ত্বিকরা বলবেন, সিনেমা হিসাবে পাঠান আর এমন কী! এমনকী যাঁরা তাত্ত্বিক নন, তাঁরাও সে কথা জানেন। আসলে সিনেমার ভালো-মন্দ সত্যিই কি কেউ উদযাপন করতে গিয়েছিলেন! বোধহয় না। উদযাপন করছিলেন শাহরুখ নামের এক ব্যক্তিকে। আরও স্পষ্ট করে বললে, শাহরুখ নামের আড়াল নিয়ে উদযাপন করতে চাইছিলেন নিজেদের অতীতকেই। সেই অতীত, যার গায়ে লেগে আছে সুরেলা সফরের স্মৃতি। ভাল লাগা গানের মতোই যা গুনগুনিয়ে ওঠে মনের গহনে। তা কেবল ঘৃণা-দ্বেষের চাষবাসে নিজেকে আর অপরকে খাটো করতে ব্যস্ত ছিল না। অন্যায় চিরকালই থাকে। কিন্তু অন্যায়ই স্বাভাবিক করে তোলার ক্ষমতাশ্রয়ী চেষ্টা যে-অতীতে সেভাবে ছিল না। মেঘদূতের যক্ষপূরী না হলেও, যে অতীত প্রণয়ীর চোখের কবিতায় হারিয়ে যেতে চাইত ও পারত দু-দণ্ড। ধর্ম-জাতি-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে যে অতীত ভালবাসার মর্ম বুঝত। যে অতীত, ইন্ডিয়া-ভারতে ভাগাভাগি না হয়ে স্বপ্ন দেখত ‘স্বদেশ’-এর। যে অতীতে দলের থেকেও দিলের কদর ছিল বেশি।
আরও শুনুন: হিন্দু হয়ে SRK যদি হতেন SEKHAR RADHA KRISHNA! ঠিক কী বদলাত? জবাব শাহরুখের
সেই অতীত আমাদের থেকে কেড়ে নিয়েছে কেউ কেউ। হয়তো তা অবধারিতই ছিল। হয়তো সেই অবধারিতের চাকা গড়ানোয় আমাদের নিজস্ব কিছু ভূমিকাও আছে। আর সেই হেতু আছে অপরাধবোধও। আজ আর চাইলেও সেখানে ফিরে যাওয়া যায় না। বর্তমানের ছেঁকায় আমর্ম ক্ষতলাঞ্ছিত হয়ে উঠে যখন আমরা হাঁফিয়ে উঠি, তখন ভেসে থাকা খড়কুটোর মতোই জড়িয়ে ধরি একটি নামকে। সে নাম শাহরুখ খান। কেননা সে নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে আমাদের কৈশোর, যৌবন, প্রেম। সে নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের উন্মুক্ত অতীত, মুক্ত মন। মিশে আছে আমাদের ফ্যাশন, প্যাশনের দিলদরিয়া দিনকাল। মিশে আছে আমাদের হারিয়ে যাওয়া স্বদেশও। শাহরুখ তাই ছুতো মাত্র। আসলে তো মানুষটাকে ধরতাই করে প্রতিবার আমরা খুঁজে ফিরি নিজেকেই। মনে হয় হয়তো আর কোনওদিনই তা ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে না, তবু একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী! আমরা চাঁদের ওপিঠে পৌঁছে তাকিয়ে দেখতে পারি, তবু নিজেদের দিকে তাকাতে আমাদের ভয়। সেই ভয় থেকে পরিত্রাণ নেই, আছে কেবল অতীতের সম্বল। অতএব প্রতিবার শাহরুখ ফিরে আসেন, আর আমরা ফিরে ফিরে বেরিয়ে পড়ি আমাদেরই অতীতের মাধুকরীতে।
শাহরুখ সত্যিই কিছু পারেন না। বিনোদনের ফেরিওয়ালা তিনি। দিনশেষে দু-দণ্ডের বিনোদন উপহার দেওয়া ছাড়া তিনি আর কী-ই বা পারেন! দেশ-কাল বদলাতে তিনি পারেন না। হয়তো চেষ্টাও করেন না। তবু তিনিই আমাদের অতীতচারী হওয়ার অন্তিম ছাড়পত্র। শাহরুখ খান আর কেউ নন, আমাদেরই ব্যক্তিগত নিরুদ্দেশের উদ্দেশে ঘোষণা।