কে না জানেন, এই ভারতবর্ষে বাজিগর একজনই। তিনি শাহরুখ খান। আমাদের সেই আকাঙ্ক্ষিত জওয়ান, যিনি চ্যালেঞ্জ নিতে জানেন, সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ ছুড়তেও জানেন। আসলে দেশের অসংখ্য মানুষের না-বলা কথা বলে উঠতে গেলে কাউকে না কাউকে তো লার্জার-দ্যান লাইফ হয়ে উঠতে হয়। হয়ে উঠতে হয় একালের রবিনহুড থুড়ি জওয়ান। বিনোদন, অ্যাকশন, থ্রিলের কড়া ককটেলে সোচ্চার হয়ে ওঠার সেই কথাটিই একান্তে বলে গেলেন কিং খান, আর তা বললেন রাজার মতোই। লিখলেন চৈতালী বক্সী।
‘জওয়ান’ সিনেমা দেখার পর হয়তো অনেকেরই ঘোর কাটছে না। কী দেখতে এসেছিলাম আর কী দেখলাম! আসলে কী দেখতে এসেছিলাম, আমরা কেউই ঠিক জানি না। তবে যা দেখলাম তা ভাবনারও অতীত। গুরুগম্ভীর কথা হালকা চালে বলার মধ্যে যে মুনশিয়ানা তা জওয়ান-এর পরতে পরতে। তাকে আমজনতার বললে আমজনতার, বিনোদনের কড়া প্যাকেজ বললে তাই-ই। আসলে মানুষ নিয়েই তো সিনেমার কারবার। আর তাই যে কথা জওয়ান বলতে চায় তা লঘু বিনোদনের চালেই যদি বলা যায়, তবে মন্দ কী! তবে এ সবই সম্ভব হয়ে উঠতে পারে শুধু একজনের জন্য।
তিনি স্বয়ং কিং খান।
আসলে শাহরুখ খান নামখানাই যথেষ্ট, আসমুদ্রহিমাচল কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য। এতদিন তাঁর ফ্যানেরা জোর গলায় তা দাবি করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে সেটা তিনি সত্যই পারেন। পারেন শত্রুকে মিত্র করে নিতে। পারেন সকলের দিকে তাঁর দু-হাত বাড়িয়ে দিতে। সে হাত ভালবাসার। কারণ তিনি তো এবার শোনাচ্ছেন এক অন্য ভারতের গল্প। আর সেই গল্প বলতে গেলে দরকার শাহরুখ নামের ব্র্যান্ডটিকেই। যে ব্র্যান্ডকে চোখ বুজিয়ে ভালবাসে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। অতএব শাহরুখ সেই কাজটিই করলেন। করলেন সিস্টেমের ভিতরে ঢুকে ভালবাসার আলোয় অন্যায়ের কুয়াশা কাটানোর কাজটি।
আরও শুনুন: শাহরুখ মানেই হারানো স্বদেশ, নিরুদ্দেশের উদ্দেশে আমাদের ব্যক্তিগত ঘোষণা
না সিনেমার গল্প বলে দেওয়া উদ্দেশ্য নয়। তা সত্ত্বেও কয়েকটা কথা বলতেই হয়। যেমন এই সিনেমায় শাহরুখ, সরকারের থেকে টাকা নিয়ে, বিলিয়ে দিলেন তাঁদের মধ্যে যাঁরা এই সিস্টেমের দ্বারা কখনও না কখনও শোষিত হয়েছেন। শাহরুখ কি তাহলে আধুনিক সময়ের রবিনহুড হতে চাইলেন? এই রবিনহুড কিন্তু ক্ষমতা বা সিস্টেমকে ব্ল্যাকমেইলও করে, বলে, সরকারের কাছে টাকা না থাকলে, কোথায় কার কাছ থেকে সেই টাকা জোগাড় করতে হবে তা তাঁর জানা আছে। আর সেই সঙ্গে প্রবল ক্ষমতার দিকেই ছুড়ে দিচ্ছে প্রশ্ন। জনতার থেকে টাকা নিয়ে সরকার শিল্পপতিদের চাহিদা মেটায়। তাহলে শিল্পপতিরাও, সরকারের প্রয়োজনে, দেশের মানুষদের জন্য নিশ্চয়ই টাকা দেবে? শুনে মনে হয়, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা বাস্তবে, আমার-আপনারই নয় তো! উত্তরটা বোধহয় আমরা সকলেই জানি। এমনই স্পর্ধা আর অবাক করা ক্যারিশ্মায়, দেশের সিস্টেমকে, আইনকে ও রাজনীতির অপব্যবহারকে, প্রশ্ন করেন চলেন শাহরুখ, আসলে প্রশ্ন করেন আমার-আপনার ‘জওয়ান’।
এটা তো হল উপরের রাজনীতি। এর তলে তলে চলে আরও এক রাজনীতির ঠান্ডা লড়াই। একটা মুখ থুবড়ে পড়া ইন্ডাস্ট্রিকে পুনরায় দাঁড় করানোর লড়াই। শুধু দেশের জন্য বা সেই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা দেশের কয়েক লক্ষ করদাতাদের জন্য নয় বোধহয়। দেশের অলি-গলিতে ছড়িয়ে পড়া হিংসা, বিদ্বেষ ও বিচ্ছিন্নতার হাওয়ার বিরুদ্ধে সে লড়াই। যা একমাত্র ভালবাসা দিয়েই জয় করা সম্ভব। শত্রু যখন মনে, আর সেই মন যখন তাঁর দেশের আমজনতার, তখন সেই লড়াই জেতার মূলমন্ত্র তিনি জানেন। তিনিই তখন বলেন, এগিয়ে এসে হাতে হাত ধরে থাকতে। সেই জড়ো হওয়া হাত আরও শক্ত করে ধরে এক জওয়ানের হাত। বলে অন্য এক ভারতের গল্প।
এইভাবে কি, এই বয়কট, গেরুয়া, মাদক, সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির হওয়াকে তিনি কলুষমুক্ত করতে পারবেন? এর উত্তরটাও জানি আমরা। শুধু জানি কেন মানিও। যে, পারলে তিনিই পারেন। আর তিনি অনেকাংশে করে দেখিয়েওছেন। হতে পারে পর্দায়, তবু স্বপ্নটা তিনি দেখিয়ে দিতে পারেন। পরপর যখন হিন্দি সিনেমার সুপারস্টারদের সিনেমা বয়কটের ডাক ওঠে, হিন্দু-মুসলিমে ভাগ করে দেওয়া হয় শিল্পীদের, সেই মারের মুখে মসিহা হয়ে তিনি এনেছেন ভালবাসার জোয়ার। অন্তরের বাঁধকে আরও শক্ত করতেই তিনি নেমেছেন, শুধু কথায় নয় তাঁর সঙ্গে সিনেমাতেও। তাঁর সঙ্গে জুড়ে যেতে চান উত্তর থেকে দক্ষিণের তাবড় তাবড় তারকারা। সীমিত পরিসরে, শুধু বলিউডি বা দক্ষিণী বা কোনও আঞ্চলিক সিনেমা হিসেবে না দেখে কিভাবে সিনেমার স্বার্থে তাঁকে ভারতীয় সিনেমা হিসেবে দেশে ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তা করে দেখিয়েছেন তিনি। আপাতত সিনেমাকে কলুষমুক্ত করাই বোধহয় এই জওয়ানের মিশন। আর সেই মিশন সফল করতে, এই জওয়ান অসংখ্যবার নিজেকে বাজি রাখতে পারেন। কে না জানেন, এই ভারতবর্ষে বাজিগর একজনই। তিনি শাহরুখ খান। আমাদের সেই আকাঙ্ক্ষিত জওয়ান, যিনি চ্যালেঞ্জ নিতে জানেন, সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ ছুড়তেও জানেন। আসলে দেশের অসংখ্য মানুষের না-বলা কথা বলে উঠতে গেলে কাউকে না কাউকে তো লার্জার-দ্যান লাইফ হয়ে উঠতে হয়। হয়ে উঠতে হয় একালের রবিনহুড থুড়ি জওয়ান। বিনোদন, অ্যাকশন, থ্রিলের কড়া ককটেলে সোচ্চার হয়ে ওঠার সেই কথাটিই একান্তে বলে গেলেন কিং খান, আর তা বললেন রাজার মতোই।