জলসাঘরের ঘেরাটোপ থেকে সাধারণের মনের মণিকোঠায় গজলকে পৌঁছে দিয়েছিল যে-কণ্ঠ, তিনি আর কেউ নন তালাত মাহমুদ। গজলের গণমুক্তির এ-কাজ করেছেন বহু বরেণ্য শিল্পীই। তবে তাঁদের পুরোধা বলতে হয় তালাত মাহমুদকে, বাংলা সঙ্গীত জগতে একসময় যিনি পরিচিত ছিলেন তপন কুমার নামে। বাঙালি আজও তাঁর কণ্ঠস্বরেই যেন খুঁজে পায় চাঁদের চোখে নেমে আসা ঘুমের ছায়া।
জলসাঘরের ঘেরাটোপ থেকে সাধারণের মনের মণিকোঠায় গজলকে পৌঁছে দিয়েছিল যে-কণ্ঠ, তিনি আর কেউ নন তালাত মাহমুদ। গজলের গণমুক্তির এ-কাজ করেছেন বহু বরেণ্য শিল্পীই। তবে তাঁদের পুরোধা বলতে হয় তালাত মাহমুদকে, বাংলা সঙ্গীত জগতে একসময় যিনি পরিচিত ছিলেন তপন কুমার নামে।
সঙ্গীত-সফরের শুরুটা হয়েছিল উত্তরপ্রদেশে। ১৪-১৫ বছর বয়স হবে তখন তালাতের। এই সময়ে দেশের কোনায় কোনায়, কে এল সায়গল-কণ্ঠীর দেখা মেলে। ভাল গাওয়ার জন্য, এলাকায় তালাতের নামও ছড়িয়েছে। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য ডাক পেলেন কিশোর তালাত। গানকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কথা তখনও ভাবেননি। সকলের অনুরোধে সেই অনুষ্ঠানে গালিবের লেখা গজল শোনাতে শুরু করলেন। তাঁর কণ্ঠস্বরে সকলে মুগ্ধ, বাহ্-বাহ্ করছে উপস্থিত জনতা। হঠাৎ ঘটল অঘটন। স্তব্ধ হয়ে গেলেন তালাত। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলঘরে যেন তখন পিন পতনের নিস্তব্ধতা। উপস্থিত জনতা বুঝতে পারছে না ঠিক কী হচ্ছে। গান থেমে গেল কেন? কয়েক মুহূর্ত সকলে হকচকিয়ে থাকার পর, একজন শ্রোতা নীরবতা ভাঙলেন। করতালিতে ভরিয়ে দিয়ে প্রশংসা জানালেন কিশোর তালাতের গায়কির। গোটা হল তখন মুখরিত করতালিতে। কিন্তু সেই ভিড়েই একজন তাঁর কাছে এসে বললেন, ‘তোমার লজ্জা হওয়া উচিত! তুমি এখনও এভাবে স্টেজের ওপর দাঁড়িয়ে আছ! তুমি গালিবের অপমান করেছ।’ আসলে গালিবের লেখা গানের একটি লাইন গেয়ে পরের লাইনটি ভুলে গিয়েছিলেন তালাত। ভরা হলঘরে কীভাবে সেটা সামাল দেবেন বুঝে উঠতে পারেননি। তাই চুপ করে গিয়েছিলেন। তবে এক দর্শকের বলা সেই কড়া কথাগুলো এতই মরমে বিঁধেছিল তাঁর, যে গান গাওয়াই থামিয়েই দিতে চেয়েছিলেন তালাত।
আরও শুনুন : ‘কবিতা তো আর স্ন্যাক্স নয়!’ মৃদুভাষে সেদিন বলে উঠেছিলেন গুলজার
কিন্তু তাঁর গজলসম্রাট হয়ে ওঠা যেন ছিল অদৃষ্টনির্ধারিত। তাঁর পিসি তাঁকে বোঝালেন- থেমে যেতে নেই। তোমার রক্তে গান আছে। তালিম চালিয়ে যাও। পিসির অনুরোধেই বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সঙ্গীতে উচ্চশিক্ষা শুরু করলেন তালাত। আর বছর কয়েকের মধ্যেই তাঁর কণ্ঠস্বরের জাদু এতদূর ছড়িয়ে পড়ে যে, কলকাতা থেকে তাঁর ডাক আসে, বিলিতি রেকর্ড সংস্থা HMV-র তরফে, গান রেকর্ড করার। ‘সব দিন এক সমান নেহি থা’ প্রথম গান রেকর্ডের জন্য সেদিন ৮০ টাকা পেয়েছিলেন তালাত মাহমুদ।
এর মাঝেই শুধু শহর নয়, ঘরও ছাড়তে হয় তাঁকে। বাবা একদিন তাঁকে বললেন, গানকে পেশা করতে হলে, এ বাড়ি-পরিবার ছাড়তে হবে তোমায়। বাবার কথা মেনে নিয়ে তিনি বাড়ি ছাড়লেন, শহরও। নামের পাশে কাপুর বা খান থাকলে যেমন বলিউডের বাজারে কাটতি বেশি ছিল একসময়, কলকাতায় তখন ছিল ‘কুমার যুগ’। তাই কলকাতায় তালাতের নাম বদলে হল তপন কুমার।
আরও শুনুন: মার্গ সংগীতের সীমানা পেরিয়েও কাছে টেনেছিলেন অগণিত শ্রোতাদের
তুমি এসো ফিরে এসো – বাংলায় প্রথম গান গাইলেন তপন কুমার। বাঙালি আজও তাঁর কণ্ঠস্বরেই যেন খুঁজে পায় চাঁদের চোখে নেমে আসা ঘুমের ছায়া। আর মুম্বইতে ট্র্যাজেডি কিং দিলীপকুমার পেয়ে গেলেন তাঁর কণ্ঠ। ‘দাগ’,থেকে ‘দেবদাস’- দর্শকদের মাতিয়ে রাখল সেই যুগলবন্দি। আর এরই মাঝে তালাতের কাছে আবার সুযোগ এসে গেল, গালিবের মুখোমুখি হওয়ার। সিনেমার নামই ‘মির্জা গালিব’। ‘৫৪ সালে মির্জা গালিব চরিত্রের জন্য তালাত মাহমুদের কণ্ঠে রেকর্ড করা সেই গান এবার আর শুধু আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলঘর নয়, শুনল আসমুদ্র হিমাচল। আর বাকিটা ইতিহাস। – দিল-এ নাদা তুঝে হুয়া কেয়া হেয়/ আখর ইস দরদ কি দবা কেয়া হ্যায়- অমন দরদি কণ্ঠ আর গায়কি ছাড়া এ-গজলও কি যুগ যুগ এমন রক্তক্ষরণ ঘটাত! তালাত মাহমুদ বর্তমানের প্রজন্মের কাছে হয়তো বিস্মৃত। তবে যাঁরা তাঁর কণ্ঠের অমৃতস্বাদ পেয়েছেন, তাঁরাই জানেন সঙ্গীতসাগর মন্থন করে কোন সুধা শ্রোতাকে উপহার দিতে পারতেন এক এবং অদ্বীতিয় তালাত মাহমুদ।