ব্যান্ডেজের ‘গজ’ শব্দটি নাকি এসেছে গাজা থেকে। প্যালেস্তাইনের সেই গাজা, ইজরায়েলি হামলায় আজ যার সারা শরীর উন্মুক্ত। রক্তাক্ত। নিজেদের পোশাক দিয়েই বুঝি এবার সেই ক্ষত ঢাকতে চাইলেন একের পর এক শিল্পী, যে অভিনব প্রতিবাদের সাক্ষী থাকল কান।
বাইরের দুনিয়ায় বোমা পড়ে। গুপ্তশত্রুর মতো ছুটে আসা স্প্লিনটার আলাদা করে দেয় হাত, পা কিংবা মাথা। ভয়ে কেঁপে উঠে নিজের শিশুটির হাত টেনে নেন শরণার্থী শিবিরে মাথা গুঁজে থাকা কেউ কেউ। সে হাতে লিখে দেন তার নাম। যাতে, মরে গেলেও গণকবরের বদলে অন্তত একটা আলাদা কবর জোটে সে শিশুর। যাতে পৃথিবী অন্তত জানতে পারে, যে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে তারা শুধু সংখ্যা নয়। তারাও মানুষ ছিল। আরেকদিকে, এইসব বারুদ ধোঁয়া মৃত্যুর থেকে অনেক দূরে সেজে ওঠে গ্ল্যামারের আসর। তার রেড কার্পেটে চোখেই পড়ে না এইসব রক্তের দাগ। একঝাঁক ফুরফুরে প্রজাপতির মতো সেখানে উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায় সুন্দরী নারী পুরুষেরা। তাদের মোম মসৃণ ত্বকে ছিটকে যায় আলো। পার্টি ব্যান্ডের ট্রাম্পেটে ঢেকে যায় বোমার আস্ফালন আর আঘাতের আর্তনাদ।
আরও শুনুন:
যে শহরে শিশু নেই, সেখানে বড়দিন আসে না
তবে ভুলে যাওয়া সকলের অভ্যাস নয়। তাই মাঝে মাঝে নন্দনকাননেও বেপরোয়া ঝড় ওঠে। স্পষ্ট প্রতিবাদ যখন গুঁড়িয়ে যেতে থাকে, তখন সাজই হয়ে ওঠে দ্রোহের হাতিয়ার। আর এবারের কান দেখল তেমনই অন্যরকম কিছু। অন্যরকম সাজ, অন্যরকম প্রতিবাদও। প্যালেস্তাইনের সেইসব মৃত শিশুর জন্য পোশাকেই প্রতিবাদ লিখলেন শিল্পীরা।
যিশুর জন্মের সময়ে শিশুদের নির্বিচারে খুন করেছিল শাসক। গাজা কিংবা রাফা-ও তেমনই শিশুদের গণকবর দেখছে এই সময়ে। সেখানে যিশু এখনও ছলছলে চোখে তাকিয়ে আছেন কি না কে জানে, তবে যুদ্ধের আগুনে পুড়ে যাওয়া শহরে যে তিনিও আশ্বাস দিতে ভুলে গিয়েছেন, তা মনে মনে জেনে গিয়েছেন শহরের বাসিন্দারা। স্বয়ং যিশুকেই যেখানে বিদ্ধ হতে হয়, সেখানে যুদ্ধের, ধ্বংসের কোনও সান্ত্বনা তিনি আর দেবেন কেমন করে? তাই কাঁটার মুকুট পরা যিশু দেখা দিয়েছেন অভিনেত্রী মাসিয়েল তাভেরাস-এর পোশাকে। অবশ্য সে দৃশ্যকে আটকাতে সঙ্গে সঙ্গেই এগিয়ে এসেছেন রক্ষীরাও।
এর আগেও, রাশিয়ার আক্রমণে তছনছ হয়ে যাওয়া ইউক্রেনের হয়ে প্রতিবাদ জারি রাখতে কান-এ পা রেখেছিলেন এক তরুণী। নগ্ন হয়েই জানিয়েছিলেন ধর্ষণের প্রতিবাদ। গ্ল্যামার আর ফ্যাশনের নন্দনকাননে মূর্তিমান সেই উপদ্রবকে থামাতে ছুটে এসেছিল রক্ষীরা। কিন্তু প্যালেস্তাইনের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে এবার তেমন স্পষ্ট পথে হাঁটেননি তারকারা। বরং রেড কার্পেটের ফ্যাশন স্টেটমেন্টেই এমন সূক্ষ্মভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন প্রতিবাদ, যাকে অবদমিত করা যাবে না, আবার অস্বীকার করাও চলবে না।
৭৭তম কান উৎসবের রেড কার্পেট ধরে অভিনেত্রী কেট ব্ল্যাঙ্কেট হেঁটে গিয়েছেন, লাল-কালো-সাদা গাউন পরে। সে পোশাকের স্লিট দেখিয়ে দিচ্ছে, পিছনের অংশটি গাঢ় সবুজ। প্যালেস্তাইনের পতাকার সব রং আশ্রয় পেয়েছে তাঁর পোশাকে। সুপারমডেল বেলা হাদিদ আবার গোলাপি রঙের যে পোশাক পরেছেন, তা তৈরি হয়েছে কেবল স্কার্ফ দিয়ে। প্যালেস্তাইনের প্রতীক, প্যালেস্তাইনের পাশে দাঁড়ানোর প্রতীক এই স্কার্ফ। ফিলিস্তিন-মার্কিন ব্যবসায়ীর মেয়ে বেলা নিজের প্রতিবাদ জারি রেখেছেন এই পোশাকেই। লরা ব্লাজম্যান-কাদারের হলুদ পোশাক জুড়ে প্যালেস্তাইনের নিহত মানুষদের ছবি, তার উপরে আরেকটি স্যাশে-তে লেখা, ওদের ঘরে ফিরিয়ে আনা হোক। হারিয়ে যাওয়া মানুষদের কথা গোটা পৃথিবীকে জানানোর জন্য রেড কার্পেটকেই বেছে নিয়েছেন তিনি।
পুরো পোশাকের বদলে অ্যাক্সেসরিজের মধ্যে দিয়েও প্রতিবাদকে ফুটিয়ে তুলেছেন অনেকে। লিলা বেখটি যেমন কালো ব্লেজারের ফর্মাল লুকে নিয়ে এসেছিলেন ছোট্ট একটি ওয়াটারমেলন পিন। ওয়াটারমেলন বা তরমুজ, লাল-সবুজ-কালো-সাদা চার রং থাকার কারণে যা এখন প্যালেস্তাইনের প্রতীক বলেই চিহ্নিত হচ্ছে। একইভাবে ভারতীয় অভিনেত্রী কানি কুসরুতির হাতে দেখা গিয়েছে একটি হ্যান্ডব্যাগ, যা দেখতে একফালি তরমুজের মতো। এই সমস্ত সাজ কোথাও স্পষ্ট, চিৎকৃত প্রতিবাদ করছে না বটে। কিন্তু এর আড়ালে লুকিয়ে থাকা চিৎকার ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে সকলকেই। প্রশ্ন করছে, “কবার তুমি অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে/ বলবে তুমি দেখছিলে না তেমন ভালো করে!”
কানের মতো যে কোনও অনুষ্ঠানেই বিপুল সাবধানতা নেওয়া হয়। যাতে কোনও প্রতিবাদের ঢেউ সেখানে অশান্তি তৈরি করতে না পারে। কিন্তু প্রতিবাদ কি আসলে অশান্তি তৈরি করে, নাকি অশান্তির জন্য দায়ী প্রতিবাদ জাগিয়ে তোলার মতো উত্তাল পরিস্থিতিই? সে পরিস্থিতির থেকে মুখ ফিরিয়ে শিল্পের, সুন্দরের সাধনা করাই যে আসলে অসুন্দর, সে কথাই মনে করিয়ে দিলেন এই তারকারা।