তৃতীয় সিজনে এসে বোঝা গেল, সচিবজি আর শহরের ছেলে নেই। তিনি ফুলেরারই একজন হয়ে গিয়েছেন। চিত্রনাট্যের এই মোচড় শুধু এই সিরিজের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং বলা যায় যে, হিন্দি সিনেমার এক বিশেষ ঘরানাতেই পরিবর্তনের ডাক দিয়ে দিয়েছেন পরিচালক দীপক কুমার মিশ্র।
সচিবজি চেয়েও ফুলেরা ছেড়ে থাকতে পারলেন না। ফুলেরার সঙ্গে তাঁর কী এমন সম্পর্ক? গিয়েছিলেন তো চাকরি করতে। আর শহরের ছেলে গ্রামে গেলে যা হয়! জলের মাছকে ডাঙায় তোলার অবস্থা। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অন্তত প্রথম দুটো সিজন ধরে সেই দ্বন্দ্ব অনেকটাই বজায় ছিল। তৃতীয় সিজনে এসে বোঝা গেল, সচিবজি আর শহরের ছেলে নেই। তিনি ফুলেরারই একজন হয়ে গিয়েছেন। চিত্রনাট্যের এই মোচড় শুধু এই সিরিজের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং বলা যায় যে, হিন্দি সিনেমার এক বিশেষ ঘরানাতেই পরিবর্তনের ডাক দিয়ে দিয়েছেন পরিচালক দীপক কুমার মিশ্র।
সেই ঘরানাটার দিকে একটু চোখ রাখা যাক। দেখা যাবে, দ্বন্দ্ব সমস্যায় আকীর্ণ একটা জনপদ। সেখানে বাইরে থেকে কেউ একজন আসছেন। তাঁরপর সেই জায়গার সব সমস্যাগুলো মিটিয়ে দিচ্ছেন নায়কোচিত ক্যারিশমায়। না মিটলেও, অন্তত মেটানোর চেষ্টা করছেন। অর্থাৎ এইসব গল্পে নায়ক মূলত বহিরাগত। যাকে বলা যায় আউট-অফ-টাউন-হিরো। ‘শোলে’ সিনেমার গল্প খেয়াল করুন। জয়-বীরুর আসা এবং গব্বর সিংয়ের সঙ্গে যে লড়াই, তা এই ধরনের আখ্যানের একটা টেমপ্লেট বলা যায়। হিন্দি সিনেমায় একাধিক ক্ষেত্রে এই বহিরাগত নায়ককে নিয়ে এসে বাজিমাত করানো হয়েছে। ২০০৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল শাহরুখ খানের সিনেমা ‘স্বদেশ’। সেই সিনেমার সঙ্গে অনেকেই ‘পঞ্চায়েত’ সিরিজের মিল খুঁজে পান। একেবারে গোড়ার যে মিলটি, তা হল, ওই নায়ক আসছেন বাইরে থেকে। ‘কহানি’ ‘কাল হোনা হো’, ‘আর্টিকেল ১৫’-র মতো একাধিক ছবি চলেছে এই সরলরেখায়। ‘পঞ্চায়েত’ সিরিজ প্রথম দুই সিজনে সেই পথই ধরেছিল। তৃতীয় সিজনে এসে তা খেলা ঘুরিয়ে দিল। দেখা গেল, সচিবজি আর বহিরাগত নন। আর তিনি একা নায়কও নন।
আরও শুনুন: ভালোবাসার হরকরা শাহরুখ-গৌরী, মাঠেও ‘ফ্যামিলি ম্যান’ বলিবাদশা
সিরিজের গল্প যেমন নানা অলিগলি বেয়ে এগোয়, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রহ্লাদের যে বিপর্যয়, তা তৃতীয় সিজনের গোড়া থেকেই আবেগের তারকে বেশ উঁচু তারেই বেঁধে রেখেছে। সেই স্রোতে দর্শককে টেনে এনেই পরিচালক ঢুকিয়ে দিয়েছেন রাজনীতির চোরাস্রোতে। অতএব আবাস যোজনার ঘর বিলি নিয়ে চলতে থাকে রাজনৈতিক টানাপোড়েন। ফুলেরা ভাগ হয়ে যায় পূর্ব আর পশ্চিমে। প্রধানজির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ চড়া হতে থাকে। আর সেই বিরোধের ফাঁক দিয়েই ঢুকে পড়ে এবারের আসল বহিরাগত- বিধায়কজি। বিধায়ক চরিত্রটিকে আগের পর্বেই দেখা গিয়েছিল। ফুলেরার সঙ্গে বিধায়কে দ্বন্দ্বের ভূমিকাটাও তৈরি করে রাখা ছিল। এবার তা নিয়ে বেশ খানিকটা খেলেছেন পরিচালক। গল্প যত এগিয়েছে, বিধায়কের সঙ্গে ফুলেরার মানুষের প্রেস্টিজ ফাইট যত গুরুত্ব পেয়েছে, তত সচিবজি ঘরের ছেলে হয়ে গিয়েছেন। এখন আর ফুলেরার প্রতি তাঁর আগের মতো বিরক্তি নেই। বরং রিঙ্কির সঙ্গে সচিবজির যে প্রেমের পূর্বাভাস ছিল, তা এবার একটু খোলতাই হয়েছে। ফলত সচিবজি যে বলেন, এখন একটু আধটু হলেও ভবিষ্যতের আলো দেখতে পান ফুলেরায়, তা অন্য অর্থ নিয়ে ধরা দেয়। সচিবজিকে ফিরিয়ে আনার জন্য গ্রামের একাংশ লড়াই করে। আবার গ্রামের সম্মান নিয়ে যখন টানাটানি পড়ে, তখন সচিবজি সকলের সঙ্গে মিলে লড়াই করেন। সচিবজি আর ফুলেরা আর আলাদা হতে পারে না। এর মধ্যেই রাজনীতির লড়াই আর একটু জোরদার হয়। গ্রামের মধ্যেই বিরুদ্ধ গোষ্ঠী সক্রিয় হয়। ঘাত-প্রতিঘাত যখন সম্মুখ সমরে গড়ায়, তখন পরিচালক বের করেন তাঁর নতুন তাস, অর্থাৎ সাংসদজিকে। তাঁকে এখনও ততটা কার্যকরী হতে দেখা যায় না। তবে যে মোক্ষম প্রশ্নে এই সিরিজ শেষ হয়েছে, তাতে ভবিষ্যতের গর্ভে যে অনেক কিছু তোলা আছে, সেই আভাসটুকু দেওয়া আছে। কিন্তু এই সমস্ত লড়াই বিরোধের মধ্যে গা বাঁচিয়ে চললেই পারতেন সচিবজি। তা তিনি করেননি। বরং গ্রামের আর পাঁচজনের মতোই একই লড়াইয়ে শামিল হন। সিরিজের শেষ পর্যন্ত গিয়ে দর্শক বোঝেন, সচিবজি বা প্রধানজি নন, এবারের নায়ক গ্রাম ফুলেরা-ই।
আরও শুনুন: অপেক্ষার ভারতবর্ষ জানে কামব্যাকের নাম শাহরুখ খান
সেই গ্রামে পঞ্চায়েত ভোটের দামাম বেজে গিয়েছে। লড়াই আর মুখে থেমে থাকেনি, রক্তপাতও হয়েছে। আর সেই পরিস্থিতিতে পুরোমাত্রায় জড়িয়ে গিয়েছেন সচিবজি। যদিও তাঁর চলে যাবার অবকাশ ছিল, তা সত্ত্বেও পরিস্থিতি তাঁকে টেনে এনেছে সবরকম সংকটের মাঝখানে। সচিবজি বিপদের মুখে ফিরেছেন স্বেচ্ছায়। হিন্দি সিনেমার চেনা ফর্মূলায় এ যেন বেশ লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন। পরিবর্তন এক মানসিকতাতেও। বহুদিন আগে লেখা এক গল্পে, এরকমই এক শহরের ছেলে পোস্টমাস্টার হয়ে গিয়েছিল গ্রামে। একই রকম বিচ্ছিন্নতা কাজ করেছিল সেখানেও। পোস্টমাস্টারের সহায়িকা বালিকাই সুখে-দুঃখে-অসুখে বাঁচিয়ে রেখেছিল পোস্টমাস্টারকে। সেই পোস্টমাস্টার যখন গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল, দ্বন্দের টানাপোড়েনে পড়া মনকে এই বলে বুঝিয়েছিল যে- ‘ফিরিয়া ফল কী, পৃথিবীতে কে কাহার!’ বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, আত্মিক সেই যোগাযোগহীনতা, সেই স্বার্থপরতা ছিল উপনিবেশের দান। ফলত সেখানে নিষ্ঠুরতার জন্ম হয়। দেখা যাবে, সিনেমা বহুবারই চেষ্টা করেছে সেই ঔপনিবেশিক ছকের বিপরীতে হাঁটতে। একাধিক বহিরাগত নায়ক চরিত্র মিলে যে ভূমিকা তৈরি হয়েছিল, পঞ্চায়েত-এর পরিচালক যেন তাকে অনেকটাই পূর্ণতা দিলেন। সচিবজি যে ফুলেরারই মানুষ হয়ে গেলেন এবং শেষ বিপদেও ফিরে না এসে পারলেন না, তার মধ্যেই থাকল পরিবর্তনের ইঙ্গিত। সারল্য-রসিকতার বাইরেও তাই পঞ্চায়েত-এর তৃতীয় পর্বের কাহিনি যেন একটি বাঁকবদলকেই চিহ্নিত করে রাখল।