গোটা বিশ্ব যা দেখছে, ভারত তা দেখছে না। সৌজন্যে, এ দেশের যৌনতা নিয়ে ছুঁতমার্গ। যে দেশ খাজুরাহো দেখেছে, ইলোরা দেখেছে, দেখেছে কোনারকও, সেই দেশই সিনেমার পর্দায় নগ্নতা দেখতে পেলে শিউরে ওঠে। আর সেই কারণেই, ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমার একটি দৃশ্য বদলে গিয়েছে ভারতে মুক্তি পাওয়া ভার্সনটিতে। যা নতুন করে প্রশ্ন তুলল এ দেশের যৌন শুচিবাই নিয়ে। শুনে নেওয়া যাক।
সঙ্গমের পর মুখোমুখি বসে নারী ও পুরুষ। যাদের মধ্যে একজন খোদ বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার, অন্যজন তাঁর প্রেমিকা জিন ট্যাটলক। কারও গায়েই একটি সুতোও নেই। হ্যাঁ, এমনটাই ছিল নাকি ওপেনহাইমার সিনেমার আসল দৃশ্যটি, যা বদলে গিয়েছে ভারতে মুক্তি পাওয়া ভার্সনে। সেখানে সঙ্গমের পরের দৃশ্যে কথোপকথনের সময় দেখা গিয়েছে, ওপেনহাইমারের ভূমিকায় কিলিয়ান মারফি নগ্ন অবস্থায় বসে থাকলেও জিন অর্থাৎ ফ্লোরেন্স পিউ-এর শরীর ঢেকে দেওয়া হয়েছে ছোট কালো পোশাকে। জানা গিয়েছে, ভারতের দর্শকের কথা মাথায় রেখে এ ছবির নির্মাতারা নিজেরাই ছবির উপর সেন্সরের কাঁচি চালিয়েছেন। সিজিআই টেকনোলজি ব্যবহার করে অভিনেত্রীর শরীরে ওই পোশাক চাপিয়েছেন খোদ ওয়ার্নার ব্রাদারস কর্তৃপক্ষই। ভারতের সিবিএফসি অর্থাৎ ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ডের নিয়ম অনুসারে, কোনও ছবিকে U/A সার্টিফিকেট পেতে হলে সেখানে নগ্নতা দেখানো যায় না। তাই, ছবিটি যাতে এক শ্রেণির দর্শকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে না পড়ে, তা নিশ্চিত করতেই এহেন সিদ্ধান্ত নির্মাতাদের। যদিও তারপরেও বিতর্ক পুরোপুরি এড়ানো যায়নি। সঙ্গমের দৃশ্যে জিনের কথা মেনে ওপেনহাইমার কেন গীতা পাঠ করছেন, তা নিয়েও বিতর্ক উসকে উঠেছে দেশে।
আরও শুনুন: জুতো খুলে লিখেছিলেন নব রামায়ণ, ‘আদিপুরুষ’ বিতর্কে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন সেই মনোজ
আর সেখানেই উঠছে প্রশ্ন। সময় যত এগিয়েছে, নানাভাবে দেশও এগিয়েছে আরও সামনের পথে। গোটা বিশ্বের কাছে এই মুহূর্তে উন্নয়নশীল দেশ বলেই পরিচিত ভারত। আর সেখানেই সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এখনও যে এহেন ছুঁতমার্গ বজায় রয়েছে, তা কি বিশ্বের কাছে আদৌ কোনও ভাল বিজ্ঞাপন? এই প্রশ্নই ঘুরছে দর্শকদের একাংশের মনে।
আরও শুনুন: ঈশ্বরের ধর্ম নেই! মুসলিম হয়েও মন্দিরে পুজো, নয়া প্রজন্মের হয়ে বার্তা দিচ্ছেন সারা?
ভারত কামসূত্রের দেশ। এখানে খাজুরাহো বা কোনারকের মন্দিরগাত্রে শোভা পায় অপরূপ সব মিথুনমূর্তি। কাংড়া থেকে মুঘল যুগ, শিল্প সাহিত্যে প্রাধান্য পায় যুগল ঘনিষ্ঠতা। হাজার হাজার বছর আগেই যৌনতাকে এমন শৈল্পিক চোখে দেখেছিলেন এ দেশের মানুষেরা। এদিকে সেই দেশেই আবার উলটো পথে হাঁটারও কমতি নেই। সিনেমায় শয্যাদৃশ্য দেখাতে, নগ্নতা দেখাতে এখানে বিস্তর আপত্তি। তাই কখনও দুটো ফুল বা প্রজাপতি দিয়ে ঘনিষ্ঠতা বোঝানো, কখনও বড়জোর নায়ক নায়িকা কাছাকাছি আসার পরই অন্ধকার- এইভাবেই শুচিতা বাঁচিয়ে চলেছে ভারতের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। পর্ন সাইটে ঘুরপথে সঙ্গমদৃশ্য চলুক, কিন্তু শিল্পের খাতিরেও প্রকাশ্যে এমন কিছু মেনে নিতে নারাজ এ দেশের সমাজ। অথচ যদি অন্যের কোনও ক্ষতি না করা হয়, সেক্ষেত্রে কে কী দেখবেন, কে কী পরবেন, কে কী শুনবেন, কোনও সভ্য দেশই কি সে বিষয়ে লাগাম টানতে পারে? হ্যাঁ, মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক ইসলামিক দেশেই সেই প্রবণতা আছে বইকি। তালিবান শাসন শুরুর পর যেমন মেয়েদের পর্দা করা নিয়ে কঠোর থেকে কঠোর হয়েছে আফগানিস্তান। হিজাব না পরার অপরাধে পুলিশি হেফাজতে মাহসা আমিনির মৃত্যু এবং তার পরে সরকারের হাবভাব চিনিয়ে দিয়েছে ইরানের নীতিপুলিশিকে। কিন্তু সেই সব আচরণ নিয়েই তো সমালোচনা শোনা গিয়েছে ভারত থেকে। তাহলে কেবল ভারত আর মধ্যপ্রাচ্যের জন্যই এভাবে সিনেমার দৃশ্যটি বদলাতে হল কেন? ছুঁতমার্গের প্রশ্নে কি তাহলে কোথাও গিয়ে ওই মানসিকতার সঙ্গে এক হয়ে গেল ভারতও? এ দেশের শিল্পসংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখেই সে প্রশ্ন তুলছেন ভারতীয় সিনে মহলের একাংশ। ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমাটি কেবল বিজ্ঞানের এক অধ্যায়কেই তুলে ধরেনি, তার সঙ্গে সঙ্গে এই গোপন শুচিবাই নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, এমনটাই মত সিনেপ্রেমীদের।