দেশভাগে সর্বশান্ত হওয়া পরিবারের ছেলে সুনীল দত্ত বাস কন্ডাক্টরের কাজ করেছেন। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর বলিউডে নিজের জায়গা করেন তিনি। ব্যাঙ্গালুরু থেকে মুম্বইয়ে এসে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন ফিরোজ খান। রাজ বব্বর আর স্মিতার জীবনও লম্বা লড়াইয়ের। অথচ এদের সন্তানেরা সেই প্রতিষ্ঠা, সম্মান মাটিতে মেশাতেই যেন জন্মেছেন! হালে শাহরুখ-পুত্র আরিয়ান মাদক কাণ্ডে গ্রেপ্তারির পর একই কাহিনির পুনরাবৃত্তি দেখলাম আমরা। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মানো স্টারকিডরা কেন বারবার কুকর্মে জড়িয়ে পড়ে?
ওঁরা স্ট্রাগল করে বড় হয়েছেন। কটু ব্যর্থতা চাখার পর স্বাদ পেয়েছেন সাফল্যের। অনেকেই বাস্তবিক ফুটপাথ থেকে পৌঁছেছেন ঝাঁ-চকচকে পাঁচতারা জীবনে। ওঁদের সন্তানদের ব্যাপারটা কিন্তু উল্টো। বাবা বা মায়ের পরিশ্রমের দৌলতে এদের জন্ম হয়েছে সোনার চামচ মুখে নিয়ে। চোখ খুলেই দেখেছে গাড়ি-বাড়ি-ব্যাংক ব্যালেন্স-নৌকর-চাকর… কোনওকিছুর অভাব নেই। এমনকি স্টারকিড হওয়ার দৌলতে কিছু না করেও প্রচারের আলোয় এসেছে। অথচ এই তারকা সন্তানদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে জড়িয়েছে কুকর্মে। পূর্বপ্রজন্মের অর্জিত মান-সম্মান ধূলিস্যাৎ করার জন্য, বাবা-মা-র মুখ পোড়ানোর জন্যই যেন জন্ম এদের! বলিউডে তো বটেই, অন্য ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা বারবার দেখা গিয়েছে।
দিল্লির রাজেন্দ্রনগরের মধবিত্ত পরিবারের ছেলেটা একদিন বলিউডের ‘কিং খান’ হবে, একথা কেউ ভাবেনি। না ভাবতে পারা এই কঠিন সড়ক দিয়েই একা হেঁটেছেন শাহরুখ খান। স্কুলে ও কলেজে থিয়েটার করেছেন, গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করেছেন, ন্যাশানাল স্কুল অব ড্রামায় পড়াশুনা করেছেন, তারপর টিভি সিরিয়াল সুযোগ পেয়েছেন। এরপর একদিন প্রথম ছবি ‘দিওয়ানা’ মুক্তি পেয়েছিল দেশজুড়ে। আরও এক দশক পরিশ্রম করে তবে আজকের পরিচয়ে পৌঁছেছিলেন শাহরুখ। কেমন সেই পরিচয়? বিদেশে ভারতীয় বলে পরিচয় দিলেই পাল্টা প্রশ্ন ধেয়ে আসে, ইয়েস ইন্ডিয়া! শাহরুখ খান! যার নামে দেশের পরিচয়, সেই বাবার নাম মাটিতে মিশিয়ে দিলেন ছেলে আরিয়ান খান। বিলাসবহুল ক্রুজের রেভ পার্টি থেকে গ্রেপ্তার হলেন নিষিদ্ধ মাদক সহ। জানা গিয়েছে, শাহরুখ-পুত্রের মাদক সেবনের অভ্যাস পুরনো। এমনকি মাদক বিক্রির অভিযোগও উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। আরিয়ানের মা গৌরি খানও অবশ্য কম যান না! একসময় তাঁর নামও জড়িয়েছে মাদক কাণ্ডে। মারিজুয়ানা সমেত ধরা পড়েছিলেন বার্লিন বিমানবন্দরে।
আরও শুনুন: মদ্যপানে তীব্র আপত্তি এই বলিউড তারকাদের, কিন্তু কেন জানেন?
সুনীল দত্ত একটা সময় জীবনধারণের জন্য বাস কন্ডাক্টরের কাজও করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই সুনীলের জীবন আর স্ট্রাগল যেন সমার্থক হয়ে উঠছিল। দত সাহেবের জন্ম পাক পাঞ্জাবে। দেশভাগে সর্বশান্ত হয়ে পরিবারটি ভারতে চলে আসে। যুবক বয়সে জীবনধারণের জন্য এটাসেটা করতে করতেই শিকে ছেঁড়ে শ্রীলঙ্কার রেডিও স্টেশনের ঘোষকের কাজ পেয়ে। সেই কাজে সাফল্যের পর দুচোখে স্বপ্ন নিয়ে বলিউডে আসেন। আবারও স্ট্রাগল করতে হয়। প্রথম ছবি ‘রেলওয়ে স্টেশন’ হলেও কেউ চেনেনি ভবিষ্যৎ তারকাটিকে। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ছবির মুক্তিতে শাপমুক্তি হয় সুনীল দত্তের। জীবনভর এমন পরিশ্রম করে যে সম্মান অর্জন করেছিলেন সুনীল দত্ত, তা ধ্বংস করার জন্যই যেন জন্ম হয়েছিল সঞ্জয় দত্তের। একটা বয়সের পর থেকেই একের পর কুকর্মে জড়িয়েছেন সঞ্জু। মাদকাশক্তি থেকে অস্ত্র আইন অমান্য করা, কুখ্যাত ডি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগও উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। আর বাবা সুনীল দত্তের কাজই ছিল, এইসব অন্যায়, অপরাধের গোলোকধাঁধাঁ থেকে ছেলেকে বের করে আনা!
ফিরোজ খানের জন্ম ব্যাঙ্গালোর শহরে। মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। তবে কিনা বলিউডে চেনাজানা ছিল না। পড়াশোনা শেষে স্বপ্নের খোঁজে তৎকালীন বোম্বাইয়ে আসেন। অনেক চেষ্টার পর কাজের সুযোগ পান। তবে কিনা সাইড রোলে মেলে। সেসব ছবি হিটও করেনি। তবু, লড়াই ছাড়েননি। অবশেষে এক বাঙালি পরিচালকের হাত ধরে সাফল্যের মুখ দেখা। ফণি মজুমদারের ‘উঁচে লোগ’ জবরদস্ত হিট করে। কালে কালে ফিরোজ খান বলিউডের রুপোলি পর্দার তারকা ফিরোজ খান হয়ে ওঠেন। আর সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মানো ফিরোজ-পুত্র ফারদিন খান? তিনি মাদক কাণ্ডে জড়ান। গ্রেফতারও হন। ৯ গ্রাম কোকেন সহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন।
আরও শুনুন: মহিলারা অলিম্পিকে পদক জিতলে খুশি, তবু কেন ‘পুরুষালি চেহারা’ নিয়ে খোঁটা!
পঞ্জাবের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে রাজ বব্বরের অভিনয়ের শখ ছোটবেলা থেকে। ফলে প্রথাগত পড়াশুনা শেষে দিল্লির ন্যাশানাল স্কুল অব ড্রামাতে ভর্তি হওয়া। সেখান থেকে মুম্বই পাড়ি দেন। থিয়েটারে অভিনয় করেন। তারপর সিনেমার সুযোগ আসে একদিন। আর স্মিতা পাতিলের জীবন শুরু হয়েছিল সংবাদ পাঠিকা হিসেবে। মাঝপথে সেই কাজ ছেড়ে পুনে ফিল্ম ইনস্টিটউটে পড়াশুনা করতে যান। সেখানকার পাট চুকিয়ে অ্যাসিসট্যান্ট সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরিচালক শ্যাম বেনেগালই স্মিতাকে ক্যামেরার সামনে নিয়ে আসেন। রাজ-স্মিতা দুজনেই পরিশ্রমে, অভিনয় প্রতিভায় সিনেমা জগতে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করেন। ওঁদের ছেলে প্রতিক বব্বরকে এতসব কাঠখড় পোড়াতে হয়নি কিন্তু। সেই ছেলেই কিনা ১৩ বছর বয়স থেকে মাদক নিতে শুরু করে। একসময় রিহ্যাবেও যেতে হয়েছিল প্রতিককে।
এছাড়াও সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর মাদক কাণ্ডে নাম জড়িয়েছে সারা আলি খান ও শ্রদ্ধা কাপুরের। একটি ঘটনার পর প্রকাশ্যে আসে স্কুল জীবন থেকেই মাদকাশক্ত ছিলেন রণবীর কাপুর। বলিউডের বাইরে ভারতীয় ক্রিকেটার কিংবদন্তি বিষণ সিং বেদীর ছেলে অঙ্গদ বেদীর একাধিক কুকীর্তির কথাও জানা আছে আমাদের। মাদকের নেশা ছাড়াও শ্লীলতাহানিতে নাম জড়িয়েছিল তাঁর।
অর্থাৎ কিনা এরা প্রত্যেকেই একটি বিষয়েই ওস্তাদ। পূর্বপ্রজন্ম অনেক খেটেখুটে যা অর্জন করেছেন, তা এক লহমায় নষ্ট করে দিতে এদের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু এমনটা কেন? মেঘ না চাইতেই জল পাওয়ার জন্যই কী? অনেকেই কিন্তু তেমনটাই মনে করেন।