কথায় বলে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস নাকি পতনের কারণ হতে পারে। কিন্তু এই প্রবাদ নিয়ে সন্দেহ জাগে নাসিরুদ্দিন শাহকে দেখলে। স্কুলে পড়ার বয়স থেকেই নিজের অভিনয়প্রতিভা নিয়ে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ছিলেন নাসিরুদ্দিন। এমনকি তার পরিচয় পেয়েছিলেন খোদ গুলজারও! কীভাবে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক সে কাহিনি।
সময়টা আশির দশক। ততদিনে দূরদর্শন এসে গিয়েছে। অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে তাতে ধরা দিচ্ছে পৃথিবীর রংমহল। আর এই দূরদর্শনের জন্যই একটি তথ্যচিত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন কবি-পরিচালক গুলজার। সে ছবির বিষয়টিও চমকে দেওয়ার মতো। খ্যাতনামা কবি গুলজার তাঁর সিনেমার অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন উর্দু কবি মির্জা গালিবের জীবন। মির্জা আসাদুল্লাহ খাঁ গালিব, যাঁর সম্পর্কে কথা ফুরোয় না। তাঁর কলমের মতোই আশ্চর্য তাঁর জীবনও। আগ্রার এক বনেদি সৈনিক পরিবারে জন্ম তাঁর। নানা উত্থান-পতন, অভাব-শোক আর দৈনন্দিন লড়াই পেরিয়ে শেষ জীবনে যাঁর সঙ্গী ছিল কেবল নিঃসঙ্গতা। তার মধ্যেই সোনা ফলিয়েছে তাঁর লেখনী। সেই বিখ্যাত শায়েরের জীবন নিয়ে ছবি বানাবেন গুলজার। এ যেন তাঁর স্বপ্নের কাজ। তাই প্রথম থেকেই এ ছবির জন্য সমস্ত সেরাটুকু খুঁজতে চেয়েছিলেন গুলজার।
আরও শুনুন: সিনেমার পর্দায় ‘প্রথম চুম্বন’, ট্যাবু ভেঙে পথ দেখিয়েছিলেন দেবিকা রানি
গালিবের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য সঞ্জীব কুমারকে নির্বাচন করলেন গুলজার। গালিব-গুলজারের যুগলবন্দি নিয়ে দর্শকের আগ্রহ তো ছিলই, এদিকে সঞ্জীব কুমার তখন রীতিমতো নামকরা অভিনেতা। ফলে তাঁর নতুন ছবির গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল দর্শকমহলে। আর এই পরিস্থিতিতেই গুলজারের কাছে এসে পৌঁছল একটি চিঠি।
চিঠিটি লিখেছে নৈনিতালের একটি মিশনারি স্কুলের এক পড়ুয়া। গুলজারকে উদ্দেশ্য করে চিঠিটি লেখা হলেও বিষয়বস্তুর দরুন সে চিঠি তাঁর সহকারীদের থেকে পাশ হয়ে আসেনি। তাঁদের আর দোষ কী! কোথাকার এক অর্বাচীন ছোকরা, সে নাকি পরামর্শ দিচ্ছে খোদ গুলজার সাবকে! তার মতে, গালিবের যা ভাষা, সেই ফারসি মিশ্রিত উর্দু উচ্চারণ করতে পারবেন না সঞ্জীব কুমার। আর তা ছাড়া শের-শায়রি তথা কবিতার সঙ্গে দূরদূরান্ত পর্যন্ত কোনও সম্পর্কই নেই তাঁর। ফলে তিনি মোটেই চরিত্রটির সঙ্গে সুবিচার করতে পারবেন না। তাই সঞ্জীব কুমার নন, একমাত্র সে নিজেই গালিবের চরিত্রে অভিনয় করার যোগ্য। তাই তার বড় হয়ে মুম্বই আসা পর্যন্ত ছবির চিন্তা বন্ধ রাখারই পরামর্শ দিয়েছিল সেই ছাত্র।
আরও শুনুন: পিতৃদত্ত নাম বদলেই বাজিমাত, চেনা তারকাদের আসল নাম তাহলে কী?
বলাই বাহুল্য, গুলজারের সহকারীরা তার বক্তব্য হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কাকতালীয় ভাবে সেসময় বন্ধ হয়ে যায় ওই ছবির কাজ। যদিও হাল ছাড়েননি গুলজার। কয়েক বছর পর ফের সেই পুরনো প্রজেক্টটি তুলে আনেন তিনি। এদিকে ততদিনে প্রয়াত হয়েছেন তাঁর পছন্দের অভিনেতা সঞ্জীব কুমার। নতুন অভিনেতা খুঁজতে গিয়ে যাঁকে মনে ধরল গুলজার সাবের, তাঁর কেরিয়ার তখন ঊর্ধ্বমুখী। দেশবিদেশের একাধিক ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি। ফলে তাঁর চড়া দর প্রযোজকের সাধ্যের বাইরে। তবুও সাতপাঁচ ভেবে একদিন তাঁর বাড়িতে কড়া নাড়লেন গুলজার।
প্রস্তাবটা শুনে গুলজারকে একটিই প্রশ্ন করেছিলেন সেই বিখ্যাত অভিনেতা। যাঁর নাম নাসিরুদ্দিন শাহ। জানতে চেয়েছিলেন, আগেরবার কোনও স্কুলছাত্রের লেখা চিঠি পেয়েছিলেন কি না গুলজার। দুজনের সওয়াল জবাবে বোঝা যায়, সেদিনের সেই স্কুলপড়ুয়া আর কেউ নন, নাসিরুদ্দিন নিজেই। নাসিরুদ্দিন সেদিন গুলজারকে কথা দিয়েছিলেন, গালিবের চরিত্র তিনিই করবেন। বলেছিলেন, “আর বাকি রইল দেনাপাওনার কথা। তা সে নিয়ে গালিবের যা দশা হয়েছিল, আমারও নাহয় তা-ই হবে। কখনও সঠিক দাম পাব, কখনও পাব না!”
হ্যাঁ, কাকতালীয় ঘটনাই বটে। তবে এমন আত্মবিশ্বাসও কি সকলের থাকে! আর সেই জোরেই সেদিন স্পটলাইট কেড়ে নিয়েছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ।