ফাওয়াদ খান ও বাণী কাপুরের অভিনয়ে ‘আবির গুলাল’ নামের যে সিনেমাটির মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল, তার মূল বিষয়েই ছিল দুই দেশের দুই নাগরিকের প্রেমকাহিনী। ভারত-পাক অশান্তির জেরে সিনেমাটির মুক্তি আটকে দেওয়া হয়েছে ভারতে। একই সময়ে, বাস্তবের পৃথিবীতে, ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে ফিরে যেতে বলা হয় সকল পাক নাগরিককে। ভারতীয় স্বামী ও সন্তান ছেড়ে সীমান্তের অন্যপারে ফিরতেই হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে পড়েন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সীমা হায়দার। আর সে জন্যই শাহরুখ খান ও প্রিটি জিন্টা অভিনীত ‘বীর-জারা’ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
শিল্পের কোনও নির্দিষ্ট দেশ হয় কিনা, সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না সহজে। তবে এ কথা বলতেই হয় যে, কেবল ‘ব্যান’ করে তাকে আটকে রাখা যায় না। জলের মতো, গন্ধের মতো, সীমান্ত পেরিয়ে অন্য দেশে অনায়াসে হানা দেয় সে। মানুষ যতই অশান্তি আঁকড়ে বাঁচতে চাক না কেন, শিল্প তাকে ঠিকই খুঁজে দেয় শান্তির ইন্ধন।
‘বর্ডার’, ‘কার্গিল’, ‘ট্যাঙ্গো চার্লি’-র মতন ক্লাসিক হোক, কিংবা হালের ‘শেরশাহ’, ‘উরি’, ‘শাম বাহাদুর’ – ভারত ও পাকিস্তানের অন্তর্বর্তী অশান্তির ছবি বারে বারে ধরা পড়েছে ভারতীয় সিনেমায়। তাতে বীররসের রমরমা, শত্রু দেশের পরাজয় আর দেশাত্মবোধের ভরপুর উদযাপন। দর্শকরাও হল ভরিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন, সিনেমার বিষয় হিসেবে দুই দেশের সংঘাত কতখানি আকর্ষক বলে বোধ হয় সাধারণের চোখে। তবে এই তালিকার মাঝেই সদর্পে অবস্থান করে যশ চোপড়া নির্মিত ‘বীর-জারা’, যেখানে ভারত-পাক সম্পর্কের টানাপোড়েনকে ছাপিয়ে গিয়েছে নারী-পুরুষের প্রেম। যদিও বর্তমানের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এমন সম্পর্ককে রূপকথা বলেই মনে হয়!
পহেলগাঁও হামলার জবাব হিসেবে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরিচালনার পর, শোনা যায় তাঁদের পরবর্তী সিনেমার নাম হিসেবে ‘অপারেশন সিঁদুর’ শব্দবন্ধটুকু রেজিস্টার করবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল সিনেমার পরিচালক-প্রযোজকরা। এমন নামের সিনেমা তৈরি হলে তার লক্ষ্যই হবে দুই দেশের মধ্যেকার হিংসা-দ্বেষের দিকটি তুলে ধরা, তা দর্শকেরা এখন থেকেই অনুমান করতে পারেন। শুধু তাই নয়, চলতি অশান্তির প্রাথমিক দিকেই ভারতে পাকিস্তানি শিল্পীদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ব্যান করা হয়। ফাওয়াদ খান ও বাণী কাপুরের অভিনয়ে ‘আবির গুলাল’ নামের যে সিনেমাটির মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল, তার মূল বিষয়েই ছিল দুই দেশের দুই নাগরিকের প্রেমকাহিনী। বর্তমানে সিনেমাটির মুক্তি আটকে দেওয়া হয়েছে ভারতে। একই সময়ে, বাস্তবের পৃথিবীতে ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে ফিরে যেতে বলা হয় সকল পাক নাগরিককে। ভারতীয় স্বামী ও সন্তান ছেড়ে সীমান্তের অন্যপারে ফিরতেই হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে পড়েন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সীমা হায়দার। আর সে জন্যই শাহরুখ খান ও প্রিটি জিন্টা অভিনীত ‘বীর-জারা’ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
সিনেমায় দেখা যায়, জারার মায়ের সামাজিক দায়বদ্ধতা বুঝেই, ভালোবাসার মানুষটিকে ত্যাগ করতে রাজি হয়ে যায় বীর (শাহরুখ)। তিক্ততা নয়, বরং নীরবে যন্ত্রণা সয়ে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। জারার মা অনুধাবন করেন যে এই ছেলেটির মতন করে হয়তো কেউই ভালবাসতে পারবে না ওঁর মেয়েকে। তবু ভারতীয় ছেলেটিকে গ্রহণ করতে পারবেন না বলে পরিস্থিতি মেনে নেন তিনিও। বীরকে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘তোমার দেশের প্রতিটা ছেলেই কি তোমার মতো?’ উত্তরে বির জানায়, ‘তা বলতে পারি না। তবে আমার দেশের প্রত্যেক মা আপনার মতো।’ রক্ত গরম করা ডায়লগ নয়, বরং এই কয়েকটা সামান্য শব্দই বুঝিয়ে দেয় যে, মায়ের ভালবাসা কিংবা নরনারীর প্রেম চিরন্তন, চিরকালীন। সীমান্ত নির্বিশেষে মনুষ্য আবেগ একই থেকে যায়। মায়ের কান্নার মতো চিরসত্য যা, তাকে কি দেশ-কালের বাঁধনে বেঁধে রাখা যায়? সমস্ত ছাপিয়ে যায় ‘অ্যায়সা দেশ হ্যায় মেরা’ গানটির লিরিকস্। কী অবলীলায় নায়ক-নায়িকা গেয়ে চলেন ‘তেরে দেশ কো ম্যায়নে দেখা, তেরে দেশ কো ম্যায়নে জানা…/ জানে কুই ইয়ে লাগতা হ্যায় মুঝকো জানা পহেচানা/ ইয়াহা ভি ওয়াহি শাম হ্যায়, ওয়াহি সবেরা…/ অ্যায়সা হি দেশ হ্যায় মেরা, জ্যায়সা দেশ হ্যায় তেরা…’ এ গানে পেশিশক্তির আস্ফালন নেই, বরং গায়ক যেন নিতান্তই শান্তিপূর্ণ ভাবে দর্শককে ধরিয়ে দিতে চান যে, দুই দেশের আচার-নিয়মে পার্থক্য থাকলেও, হৃদয় আদতে একই। সিনেমা দেখতে দেখতে দর্শকও আকুল হয়ে পড়েন বীরের মুক্তির জন্য, অপছন্দের মানুষকে বিয়ে করে জারার কী পরিণতি হয়, তা দেখার জন্য। সেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ। অমূলক হয়ে ওঠে দুই দেশের মাঝে থাকা সীমান্তখানি।
হাজারও খণ্ডে বিভক্ত হওয়া পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে, দু’দন্ড শান্তির স্বপ্ন দেখায় বীর-জারা। ভালোবাসা, সহানুভূতি, টানের মতো সমস্ত মনুষ্যচিত আবেগকে নিরর্থক বলে দাগিয়ে দিতে চায় দেশীয় রাজনীতি; ‘বীর-জারা’ যেন সে বন্দুকের নলের মুখে গুঁজে দিতে চায় গোলাপ।