শুধু বাংলা নয়, তাঁর মতো শিল্পীকে পেয়ে গৌরবময় হয়ে ওঠে গোটা দেশের সংগীতের ইতিহাস।
কোন ইন্দ্রধনু যে তাঁর গানে স্বপ্ন ছড়িয়ে দিত কে জানে! সব কথা-গান সুরে সুরে কী করে যে রূপকথা হয়ে যায়, বাঙালি সে ইন্দ্রজালের রহস্যভেদ চায়নি কখনও। শুধু জেনেছে মায়াভরা চাঁদ আর মায়াবিনী রাত জেগে ওঠে এক ঐশ্বরিক কণ্ঠমাধুর্যেই। হৃদয় ভরে ওঠে সেই মধুক্ষরা কণ্ঠের সম্মোহনে। তিনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। শুধু বাংলা নয়, তাঁর মতো শিল্পীকে পেয়ে গৌরবময় হয়ে ওঠে গোটা দেশের সংগীতের ইতিহাস।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের এই কণ্ঠ একদিক থেকে বাঙালির কাছে নিবিশ্র আশ্রয়। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশবাসী বাস্তবিক জীবনে যে সুখচ্ছবি দেখতে চেয়েছিল, সিনেমার পর্দায় তারই যেন আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন দুজন মানুষ। উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন। কাহিনির বিন্যাসে বাঙালির স্বপ্নের শান্তিনিকেতন যেন নির্মিত হচ্ছিল তাঁদের কেন্দ্র করেই। আর তাঁদের নেপথ্যে থেকে সুরের সোনার ভুবন রচনা করছিলেন অন্য দুজন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে সুচিত্রার লিপে সন্ধ্যা গাইলেন সেই অবিস্মরণীয় গান – গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু। বাংলা ছায়াছবির গানে যেন খুলে গেল এক অন্য দুয়ার। এই যুগলবন্দির ঐশ্বর্য ক্রমে হয়ে উঠবে বাঙালির আদরের ধন, চিরকালের সম্পদ।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সংগীতের সফর অবশ্য এই বিন্দু থেকে শুরু হয় না। তাঁর সুরের আকাশ যেমন ব্যাপ্ত, তেমনই তার বর্ণময় উদ্ভাস। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত, আধুনিক গান এবং ছায়াছবির গান – সঙ্গীতের প্রায় সব আঙ্গিকেই যাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ, তাঁর দিকে তাকিয়ে কেবল বিস্মিতই হতে হয়। উত্তরাধিকার সূত্রেই সঙ্গীতকে পেয়েছিলেন সন্ধ্যা। তবে সেই উত্তরাধিকারকে তিনি যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন তা অতুলনীয়। ঈরশ্বদত্ত প্রতিভা যেমন পেয়েছিলেন, তেমনই ছিল তাঁর সুরের সাধনা। এমনকী খ্যাতির মধ্যগগনে যখন, তখনও শিক্ষার্থীর মতোই করেছেন সুরের অনুশীলন। নাড়া বেঁধে সুরের শিক্ষা নিয়েছেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান সাহেবের কাছে। একদিকে পেশাগত কাজ, অন্যদিকে নিজের শিক্ষা। নিবিড় অধ্যাবসায়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন সুরের সাধিকা। অসংখ্য সিনেমার গান বা বেসিক গান তো আছেই। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অসামান্য শাস্ত্রীয় সংগীত পারদর্শিতাও ধরা আছে বিভিন্ন রেকর্ডে। বাঙালি শ্রোতা আজও তা ভোলেনি।
একদিকে ছায়াছবির গানে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করছেন। অন্যদিকে চলছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুশীলন। এই ছিল তাঁর সংগীত সাধনার ব্যাপ্তি। এর শুরুটা হয়েছিল একেবারে ছোটবেলাতেই। ১২ বছর মাত্র বয়স তখন তাঁর। অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স আয়োজিত পরীক্ষায় ভজনে প্রথম হলেন সন্ধ্যা। আর কিছুদিন পরেই গীতশ্রী পরীক্ষাতেও তিনি প্রথম হলেন। সেই স্বীকৃত আজীবন তাঁর নামের সঙ্গে থেকে গিয়েছে। ১৪ বছরও বয়স হয়নি সন্ধ্যার, প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয় এইচএমভি থেকে। প্রথম প্লে-ব্যাক করলেন নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে। ‘সমাপিকা’ ছবিতে সংগীত পরিচালক রবীন চট্টোপাধ্যায় তাঁকে দিয়ে গান গাওয়ালেন। ডাক এল বিখ্যাত সুরকার রাইচাঁদ বড়ালেরও। ‘অঞ্জনগড়’ ছবিতে গাইলেন তাঁর তত্ত্ববধানে। সেই শুরু। তারপর দীর্ঘ কয়েক দশক বাংলা ছায়াছবির গানকে অন্য মাত্রা দিলেন সন্ধ্যা। পর্দার সুচিত্রা দর্শকের চোখে ভেসে ওঠা মানেই অবধারিত ছিল সন্ধ্যার কণ্ঠ। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারদর্শী সন্ধ্যা। কিন্তু ছবির গানে বা আধুনিক গানে সেই ছোঁয়া সেভাবে পড়তে দেননি। একদিকে অনুভবের ফুল ফোটাচ্ছেন সুরের চলনে, অন্যদিকে সুরের নিখুঁত বসতি তাঁর কণ্ঠে। সঙ্গীত পরিচালকরা একের পর স্বপ্নের কাজ করেছেন সেই স্বর্ণসময়ে, আর তাঁদের সহায় হয়েছে সন্ধ্যায় সাংগীতিক বোধ, শিক্ষা এবং অসামান্য গায়কি। বাংলা ছায়াছবির গানের পাশাপাশি আধুনিক গানও ক্রমশ পাচ্ছিল সন্ধ্যা-ছোঁয়া। আসলে উত্তরকালের জন্য তৈরি হচ্ছিল সঙ্গীতের ইতিহাস। যে ইতিহাসের পথ ধরে এগিয়ে যাবে বাংলা গান।
তাঁর ঐহিক চলে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। সে তো আটকানো যায় না। তবে তাঁর মধুক্ষরা কণ্ঠের জাদু থামবে না। তা থেকে গেল মহাকালের সম্পদ হয়েই। বাংলা গান যত আধুনিকতার পথে এগোবে, যতবার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে শুনবে, ততবার বিস্ময়ে আবিষ্কার করবে সুরের আকাশে সন্ধ্যাতারা হয়েই জেগে আছেন এই কিংবদন্তি শিল্পী।