তিনি যে ক্রমে ধরা-ছোঁয়ার অতীত উত্তমকুমার হয়ে উঠলেন বা নিজেকে নিয়ে গেলেন সেই অগমপারের অলৌকিকতায়- তা যেন এক ‘সোনার খাঁচা’য় বন্দি মানুষের উপাখ্যান। উপমাটি তরুণ মজুমদারের। তাঁর ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ যাত্রার সাতকাহন বর্ণনা করতে করতে যখন এল উত্তম-প্রসঙ্গ, তখন তাঁর মনের পটে ধরা দিয়েছে এক আড্ডাপ্রাণ, সদাহাস্যময়, বন্ধুবৎসল যুবক।
বাঙালির কাছে উত্তমকুমার ঠিক কী? বাঙালি বলেই এ-প্রশ্নের উত্তর বোধহয় এক কথাতেই দেওয়া সম্ভব। উত্তমকুমার উত্তমকুমার-ই। কোনও ব্যাখ্যা, কোনও সংজ্ঞায় তাঁকে বেঁধে ফেলে যায় না। সে চেষ্টা কি হয়নি! হয়েছে। কতভাবেই না উত্তমকুমার নামক ইন্দ্রজালটিকে দেখা-বোঝার চেষ্টা করেছেন কত না গুণীজন! তবে তাতে কী! তিনি বড় অভিনেতা, তিনি নায়কের নায়ক মহানায়ক, তিনি তীব্র পুরুষ ও প্রেমিক, তিনি বাঙালির সযত্নলালিত অতিকথা- যেদিক থেকেই তাঁকে ধরার চেষ্টা করা হোক না উত্তমকুমার নামক ঘটনাটি যেন কেবলই উপচে পড়ে। অর্থ-কীর্তি-সফলতা-প্রেম পেরিয়ে বাঙালির উত্তমকুমার এক বিকল্প বাস্তবতার আস্ত পৃথিবী। তাঁকে সহজে ব্যাখ্যা করা যায় এমন সাধ্য কোথায়!
আরও শুনুন: অলৌকিক সন্ন্যাসীর দেখা পেলেন হতাশ যুবক, বাঙালি পেল তার চিরকালের উত্তমকুমার
এই যে তিনি ক্রমে ধরা-ছোঁয়ার অতীত উত্তমকুমার হয়ে উঠলেন বা নিজেকে নিয়ে গেলেন সেই অগমপারের অলৌকিকতায়- তা যেন এক ‘সোনার খাঁচা’য় বন্দি মানুষের উপাখ্যান। উপমাটি তরুণ মজুমদারের। তাঁর ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ যাত্রার সাতকাহন বর্ণনা করতে করতে যখন এল উত্তম-প্রসঙ্গ, তখন তাঁর মনের পটে ধরা দিয়েছে এক আড্ডাপ্রাণ, সদাহাস্যময়, বন্ধুবৎসল যুবক। যে যুবকটি ক্রমে হয়ে উঠেছেন ‘দূর আকাশের তারা’। তরুণবাবু লিখেছেন, “বাংলা ছায়াছবির একচ্ছত্র রাজকুমার, অর্থাৎ, যাকে বলে, ‘ম্যাটিনি আইডল’ হওয়া সত্ত্বেও, অভাবনীয় জনপ্রিয়তার চূড়ায় দাঁড়িয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নেওয়া সত্ত্বেও, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির গড়ে দেওয়া নকল ‘গ্ল্যামার কিং’-এর মুখোশ আর বেশবাস পরে গজদন্তমিনারবাসী, লার্জার-দ্যান-লাইফ ইমেজের ঘেরাটোপে বন্দি, সাধারণ মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে প্রায় স্বপ্নলোকের অলীক কোনও নায়কের অভিনয় দিনের পর দিন চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আসল উত্তমকুমার তার মেজাজে আর স্বভাবে ছিল একদম বিপরীত। … কিন্তু যেটা বলার জন্য আজ এই কলম ধরা তা হচ্ছে এই যে, উত্তমের মতো একটা সদাহাস্যময়, আটপৌরে, বন্ধুবৎসল যুবককে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি একটা প্রকাণ্ড, শক্তপোক্ত সোনার খাঁচা বানিয়ে, তার ভিতর তাকে পুরে, পায়ে সোনার শেকল বেঁধে, বরাবরের জন্য ‘দূর আকাশের তারা’ বানিয়ে দিল। ‘মেগা স্টার’ বানাবার জন্য মানুষের দূরত্ব বাড়িয়ে দিল। ফলে, আসল মানুষটা চাপা পড়ে রইল জন্মের মতো।”
আরও শুনুন: গুন্ডাদের চোখে চোখ রেখে এগোলেন উত্তমকুমার, তারপর…
হয়তো উত্তমকুমার হয়ে ওঠার এটাই নিয়তি। সেই ভবিতব্যের অতলে ক্রমশ তলিয়ে গিয়েছেন সেই মানুষটি, যিনি মন ফুরফুরে থাকলে বলে উঠতেন হরি-বোল। শোকের ধ্বনি নয়। হরির লুটের ঘোরলাগা যে আনন্দধ্বনি, তাই-ই লেগে থাকত তাঁর মুখে। আসলে, অভিনয় আর জীবন, কিংবা অভিনেতার জীবন আর চরিত্রের জীবন মিলেমিশে গিয়েই বোধহয় উত্তমকুমারের জন্ম। সৎ অভিনয় কেমন হবে? সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট ভাবনা ছিল তাঁর। শ্রদ্ধেয় অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী তাঁকে শুনিয়েছিলেন এক গল্প। যেখানে ভক্ত চরিত্রে অভিনয় করতে করতেই এক ব্যক্তি অন্তরে টের পেয়েছিলেন অধ্যাত্ম-স্ফূরণ। উত্তমকুমার স্বয়ং বিশ্বাস করতেন, ‘সৎ চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে যদি সে সত্যি চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য চেষ্টা করে, তবে আখেরে সে সৎ-ই হয়ে যায়।’ এই প্রসঙ্গে তাঁর ভাবনার দোসর হয়েছিল ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের একটি বাণী। ঠাকুর বলেছিলেন, মন ধোপা ঘরের কাপড়। একে যে রঙে রাঙাবে, সেই রং হবে। অভিনয় আর অভিনেতার মন প্রসঙ্গে উত্তমকুমারের দর্শনটি যেন এই বাণীই স্পর্শ করে ছিল গোড়া থেকে।
আর তাই কালে কালে স্বপ্নলোকের নায়ক হয়ে থাকতে থাকতে চাপা পড়ে গেল সেই হই-হই করা মানুষটি। অভিনেতার মন কখন যেন মিশে গেল ব্যক্তিমানুষের মনেও। সে মনের ভিতর অজস্র ঝড়, দ্বন্দ্ব, টানাপোড়েন। ব্যক্তির ইচ্ছে-বাসনা-আকাঙ্ক্ষা আর ওই সোনার খাঁচায় বন্দি মানুষের আখ্যানে দুস্তর ফারাক। দুয়ের মাঝে অনেক যন্ত্রণা আর রক্তক্ষরণ। সে সব সামলে মানুষের মনের মতো হয়ে ওঠা, মনের মতো হয়ে থেকে যাওয়ার দুরূহ কাজটি প্রায় কেউই করে উঠতে পারেন না। তিনি পেরেছিলেন। পেরেছিলেন বলেই তিনি আজও বাঙালির সর্বোত্তম; এক এবং নির্বিকল্প- উত্তমকুমার।