তিনি কিংবদন্তি। যেমন তাঁর কণ্ঠের ঐশ্বর্য, সুরের মায়াজাল; তেমনই তাঁর খামখেয়ালিপনা। কিশোরকুমার মানেই যেন এক আশ্চর্য ধাঁধা। সে-ধাঁধার ভিতর যেমন আছে ভারতীয় সংগীতজগতের মণিমুক্তো, তেমনই তাঁকে নিয়ে সরস গল্পেরও অভাব নেই। হিন্দি, বাংলা- দুই সিনেমাপাড়ার অন্দরে কান পাতলেই শোনা যেত কিশোরকুমারকে নিয়ে মজার গল্পমালা। আসলে আজীবন নিজের মধ্যে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন এক চিরকিশোর মন। আসুন শুনে নিই, প্রবাদপ্রতিম সেই শিল্পীকে নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তেমনই কয়েকটি গল্প।
রিহার্সাল করতে করতে কিছুক্ষণের জন্য উঠে গিয়েছেন শচীনকত্তা, অর্থাৎ শচীন দেববর্মণ। ফাঁকা হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে কলকাতা থেকে আসা পরিচালককে গান শোনাতে বসলেন কিশোর কুমার। অনেকদিন বাদে প্রিয় মানুষটির দেখা পেয়ে তিনি তখন মজলিশি মেজাজে। বাজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধরলেন শচীনকত্তারই গান। কিন্তু নিজের স্বাভাবিক গায়কিতে নয়। পরিচালক অবাক হয়ে শুনলেন, আনুনাসিক সুরে অবিকল শচীন দেববর্মণের মতো করেই সে গান গেয়ে চলেছেন কিশোর। এমন নিখুঁত অনুকরণে মজলিশ না জমে কি আর উপায় আছে! এদিকে কখন যে খোদ শচীন দেববর্মণ দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন, সেদিকে খেয়ালই ছিল না কারও। তাঁর মুখ লাল, থমথম করছে। সংবিৎ ফিরতেই হারমোনিয়াম ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন কিশোর কুমার। পায়ে পায়ে পিছিয়ে গেলেন ঘরের জানলাটির দিকে, যেন কিছুই হয়নি। আর জানলার সামনে পৌঁছেই, তিনি অ্যাবাউট টার্ন করে উধাও। শচীন দেববর্মণের পাশাপাশি সেদিন পরিচালক তরুণ মজুমদারও জানলায় দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন, জানলা গলে কার্নিশে বেরিয়েই কীভাবে রেনপাইপ বেয়ে হুড়মুড়িয়ে নিচে নেমে পালিয়েছিলেন সেকালের সুপারস্টার কিশোর কুমার। আর সেই দৃশ্য দেখে শচীনকত্তা যে সব রাগ ভুলে অস্ফুটে বলে উঠেছিলেন ‘বান্দর’, সে গল্পও শুনিয়েছেন তরুণ মজুমদারই।
আরও শুনুন: সলিল চৌধুরীর গান গাইতে গিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন কিশোর কুমার, কেন জানেন?
আসলে কিশোর কুমার ছিলেন এমনটাই। তাঁকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বারবার এ কথাই বলেছেন, বিপুল প্রতিভা আর উপচে পড়া অর্থ-যশ-বৈভবের পাশাপাশি শিশুর মতো মনটিকে আজীবন বাঁচিয়ে রেখেছিলেন কিশোর। স্টুডিওপাড়ায় তাঁর কিংবদন্তি প্রতিভার যত গল্প শোনা যায়, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে তাঁকে নিয়ে সরস গল্পও। এই দুয়ের এক আশ্চর্য যুগলবন্দি মেলে লতা মঙ্গেশকরের কথায়। কিশোর কুমারের সঙ্গে ডুয়েট গাইতে হলে নাকি রীতিমতো ভয়ে ভয়ে থাকতেন সুরের সম্রাজ্ঞী। কেন হত এমনটা? আসলে গান শুরু হত একসঙ্গেই। কিন্তু লতা যখনই একক অংশের গান ধরতেন, অমনি মাইক থেকে সরে গিয়ে যন্ত্রীদের সঙ্গে খুনসুটি জুড়ে দিতেন কিশোর। গানের ধরতাই তিনি সময়মতো ধরতে পারবেন কি না, এই চিন্তায় গাইতে গাইতে রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন লতা। আর তারপরেই আশ্চর্য হয়ে দেখতেন, চিন্তার কোনও কারণই ছিল না। কারণ সবাইকে চমকে দিয়ে নিজের লাইনটি একদম মোক্ষম সময়ে এসে ধরে ফেলতেন কিশোর। কোনওবার ভুল হয়নি তাঁর। শুধু তাই নয়, এত কাণ্ডের পরেও সুর-তাল-লয়, এমনকি গানের প্রয়োজনীয় আবেগও থাকত একেবারে নিখুঁত। আবার একবার, গানের এক জায়গায় ট্রেনার বলেছিলেন মিষ্টি করে গাইতে। পরে দেখা গেল, স্বরলিপির সেই জায়গায় একখানা কোকিলের ছবি এঁকে রেখেছেন কিশোর কুমার।
আরও শুনুন: স্টেজে গান গাইতে বেজায় ভয় কিশোর কুমারের! কী করে তা কাটল জানেন?
শুধু স্টুডিওপাড়াতেই যে এমন কাণ্ডকারখানা চালাতেন, তা নয় কিন্তু। নিজের ফ্ল্যাটের বাইরে তিনি নাকি লিখে রেখেছিলেন, ‘কিশোর হইতে সাবধান’। বিশেষ করে এক-একজন প্রোডিউসারের সঙ্গে তিনি যেসব কাণ্ড করেছিলেন, তাতে এ কথা বলাই চলে। একবার তাঁর বাড়িতেই গিয়েছেন এক প্রযোজক। কিন্তু তাঁর সঙ্গে তখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। এদিকে বেরিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। তাই আশ্রয় নিলেন একটি আলমারির। সেই আলমারির মধ্যেই লুকোনো সিঁড়ি তৈরি করিয়েছিলেন তিনি, যাতে সেখান থেকে সোজা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যাওয়া যায়। আবার আরেক প্রযোজকের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন, তাঁকে ছবিতে নিতে গেলে প্রযোজককে আসতে হবে তাঁর বাড়িতে। তবে সাধারণভাবে নয়। আসতে হবে হাফ-প্যান্টের ওপর কুর্তা পরে, মুখে থাকবে পান, উপরন্তু তার পিক গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে। কিশোর কুমারকে ছবিতে নেওয়ার জন্য অবিকল সেই সাজেই হাজির হয়েছিলেন ওই প্রযোজক। এই গল্প জানিয়েছিলেন খোদ গুলজার সাহেব। তিনিই জানিয়েছিলেন, ‘আনন্দ’ সিনেমার নায়কের চরিত্রের জন্য কিশোর কুমারকেই ভেবেছিলেন পরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু শুটিং-এর কয়েক দিন আগে গোটা মাথা ন্যাড়া করে তাঁর অফিসে এসে হাজির হলেন কিশোর। গুলজারের কথায়, “হয়তো কিশোরদার ওটা অভিনয় করার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু এ ভাবে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করতে আমি কাউকে দেখিনি।”
আরও শুনুন: ‘মানিকমামা’-র ছবিতে গান গেয়ে পারিশ্রমিক নিতেন না কিশোর কুমার
তাঁর এমন সব খামখেয়ালি কাজকর্মে কেউ হেসেছেন, কেউ বিরক্ত হয়েছেন কখনও কখনও। কিন্তু কিশোর কুমারকে অস্বীকার করার সাধ্য হয়নি কারোরই। প্রতিভা আর খামখেয়ালিপনা যে হাত ধরাধরি করে চলে, তা ফের একবার প্রমাণ করে দিয়েছেন এই কিংবদন্তি শিল্পী।