ছবির পটভূমিকায় উঠে এসেছে গুজরাট অশান্তির প্রসঙ্গ। তাতেই যত আপত্তি। এমনকি সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র দেওয়ার পরও ছবি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ১৭টি দৃশ্য। স্বাভাবিক ভাবেই এই নিয়ে বিতর্ক উসকে উঠছে। প্রশ্ন উঠছে, শিল্পের স্বাধীনতা আদৌ আছে?
সিনেমায় কাঁচি চালিয়েছে সেন্সর বোর্ড। সেই নিয়ে আক্ষেপ নির্মাতাদের। এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে এক্ষেত্রে বিষয়টা একটু আলাদা। সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র দেওয়ার পরও সিনেমার বেশ কিছু দৃশ্যে বদল আনা হয়েছে। বলা ভালো, বদল আনতে বাধ্য করা হয়েছে।
বিতর্কের কেন্দ্রে মালয়ালাম ছবি ‘এল ২ এমপুরান’। জানা যাচ্ছে, সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেয়ে যাওয়ার পরেও এই ছবির ১৭টি দৃশ্যে কাঁচি চালানো হয়েছে। মূলত নারী নির্যাতন এবং অশান্তির দৃশ্যগুলিতেই কাঁচি চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নির্মাতারা। এছাড়াও সিনেমার প্রধান খলনায়ক বাবা বজরঙ্গির নাম পালটে ফেলা হবে। মিউট করে দেওয়া হবে বেশ কিছু সংলাপও। নতুন করে ছবিটি মুক্তি পাবে প্রেক্ষাগৃহে। আর এখানেই প্রশ্ন উঠছে, সমস্যাটা কোথায়? তাতে উঠে আসছে গুজরাট প্রসঙ্গ। নাহ না, আজকের গুজরাট নয়, ২০০২ সালের গুজরাট। পশ্চিমের এই রাজ্য আজকের দিনে যেভাবেই পরিচিত হোক, ২০০২ সালের গুজরাট অশান্তির কথা ভোলার নয়। সেই পরিস্থিতি, রাজনীতি, হিংসার কথাই থ্রিলারের আড়ালে স্পষ্ট হয়েছে সিনেমায়। টানটান উত্তেজনায় মোড়া এই সিনেমায় ভরপুর বিনোদন, তারসঙ্গে যে কঠিন সত্যি সামনে আনা হয়েছে, তা মানতে সমস্যা হয়েছে অনেকের। উঠেছে আপত্তি। খোদ আরএসএস কর্তা, সিনেমাটিকে ‘বামপন্থী চক্রান্ত’ বলে দাগিয়েছেন। শুধু তাই নয়। ছবি মুক্তির পরেই প্রযোজকের বাড়িতে কেন্দ্রীয় এজেন্সির তল্লাশি, কোন বার্তা দিতে চেয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই পদক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছেন নির্মাতারা।
এ প্রসঙ্গে তাদের দাবি, সিনেমাটি যাতে কোনও সম্প্রদায়ের ভাবাবেগে আঘাত না করে, সেজন্য এমন পদক্ষেপ। ছবিতে মোহনলাল, পৃথ্বীরাজ সুকুমারনের মতো তারকা রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁরাও বিশেষ বার্তা দিয়েছেন। খোদ মোহনলাল বলছেন, এই ছবির জন্য যদি কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন তাহলে তার প্রতিকার করাও তাদের কর্তব্য। বিষয়টা যে স্বেচ্ছায় করা হবে, একথাও ঘোষণা করেন অভিনেতা। তবে কেন প্রথমেই সেসব মাথায় রেখে ছবিটি তৈরি হয়নি, সে প্রশ্নও পালটা উঠে আসছে। তবে কি স্রেফ গুজরাট অশান্তির প্রসঙ্গ রয়েছে বলেই এমন পদক্ষেপ করাতে বাধ্য করা হল? প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বলিউডের ছবি নিয়ে আপত্তি, নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন কারণে ছবি বয়কটের ডাক দিয়েছে সোশাল দুনিয়া। তাতে বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা সাময়িক। এক্ষেত্রে ব্যাপারটা বড় আকার নিয়েছে তার অন্যতম কারণ, এর কেন্দ্রে বলিউড নয় মালয়ালম ইন্ডাস্ট্রি। প্রতিবাদ যেমন হচ্ছে, বিতর্কও ঘনাচ্ছে ধীরে ধীরে। আর সেইসঙ্গে ফিরছে পুরনো প্রশ্ন, এ দেশে শিল্পের স্বাধীনতা আদৌ আছে? কিছুদিন আগেই ‘কালী’ তথ্যচিত্রের পোস্টার নিয়ে বিরোধিতায় সরব হয়েছিল একাধিক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। তখন শিল্পের অধিকার নিয়ে পাল্টা আওয়াজ তুলেছিলেন অনেকেই। তবে সেই যুক্তি গৃহীত হয়নি। তালিকায় মালয়ালাম ছবি যে নেই তা নয়। ‘পুঝা মুথল পুঝা ভারে’ ছবিটি ঘিরেও বেশ বিতর্ক হয়েছিল। সিনেমার মূল পটভূমি ছিল ১৯২১ সালের মালাবার হিন্দু গণহত্যা। খিলাফৎ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সেসময় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে লেগে গিয়েছিল বড়সড় অশান্তি। মোপলাহ তথা মাপ্পিলা বিদ্রোহীদের হাতে প্রাণ গিয়েছিল অন্তত ৩৮ জন হিন্দুর। সেই ইতিহাসকেই তুলে ধরা হয়েছে মালয়ালম এই ছবিটিতে। স্বাভাবিক ভাবেই বেশ কিছু নৃশংস এবং আপত্তিজনক দৃশ্য ছিল। সেসব যারপরনায় কাঁচি চালানোর নির্দেশ দেয় সেন্সর বোর্ড। সেই নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকে। বিতর্কের জল গড়ায় বহুদূর। এবার অবশ্য সেন্সর বোর্ডের আপত্তি সামগ্রিক নয়। বরং নির্মাতাদেরই বাধ্য করা হয়েছে ছবির দৃশ্য বদলাতে। হয়তো ভাবা হয়েছিল ঘুরিয়ে দেখানো এই পথে কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু না, বিষয়টা সকলের কাছেই জলের মতো পরিষ্কার হয়েছে। তাই এ নিয়ে বিতর্কও তৈরি হচ্ছে।