রাজ চক্রবর্তী ফিরলেন। ফিরলেন রাজ চক্রবর্তী হয়েই। সদ্য রিলিজ হওয়া তাঁর ওয়েব সিরিজ ‘আবার প্রলয়’-এ সুপারকপ অনিমেষ দত্ত ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হয়ে যখন স্ক্রিন শাসন করলেন, পরিচালক যেন সেই অবসরেই দর্শকের মনে ঢুকিয়ে দিলেন নানা পরতের ভাবনার রসদ। ‘আবার প্রলয়’ তাই শুধু অ্যাকশন-প্যাকড সিরিজ হয়েই থাকল না। বরং জোর করে দাগিয়ে না দিয়েও অনেক কথাই বলে গেল নতুন এই সিরিজ। আসুন শুনে নেওয়া যাক সে-কথা।
ওটিটি নাকি সিনেমা! ভবিষ্যতের দুনিয়া শাসন করবে কে? আজকের দিনে এ প্রশ্ন ঘোরতর বাস্তব। দুই পক্ষেরই নির্দিষ্ট যুক্তি আছে। তবে, সেই সব যুক্তি-তক্কো পেরিয়ে আদতে যে গপ্পো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তা হল দর্শকের সন্তুষ্টি। বড় পর্দায় রাজের ম্যাজিক সম্পর্কে বাঙালি দর্শক পরিচিত। তাঁর সিনেমা মানেই দর্শকের হলে ভিড়। টানটান ছবি দেখার রোমাঞ্চ। সেই রাজ চক্রবর্তী যখন তাঁর প্রথম ওয়েব সিরিজ নিয়ে এলেন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই দর্শকের কৌতূহল ছিল তুঙ্গে। ‘আবার প্রলয়’-এ নিজের দর্শককে খুশিই করেছেন পরিচালক। চিত্রনাট্যে আকর্ষণের চুম্বক যথেষ্টই। অতএব দর্শকের চোখের পলক ফেলার জো নেই। ওয়েব সিরিজ দর্শককে যে চমকে টেনে নিয়ে যায়, তা মজুত প্রতি এপিশোডেই। বাস্তব সমস্যার আধারেই লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্রকে নিয়ে এসে যে রসায়নের জন্ম দিয়েছেন পরিচালক, তা সফলই বলা যায়।
আরও শুনুন: সুস্মিতার ‘তালি’ সিনেমার নেপথ্যে গৌরী, কেন তাঁর জীবন উঠে এল পর্দায়?
সত্যি বলতে, বাংলা সিনেমার দর্শক অনিমেষ দত্তকে বেজায় ভালবাসেন। একদা ‘শত্রু’ ছবিতে শুভঙ্কর সান্যাল হয়ে রঞ্জিত মল্লিক পর্দায় ন্যায় প্রতিষ্ঠার যে লড়াই করেছিলেন, অনিমেষ দত্তকে তার উত্তরসূরি বললে বোধহয় ভুল বলা হবে না। এ কথা তো ঠিক যে, নানা সামাজিক অন্যায়ের প্রতিকার চেয়ে বহু ক্ষেত্রে হতাশ হয়েই ফিরতে হয় মানুষকে। আস্থা হারায় পুলিশ-প্রশাসনের বিররুদ্ধে। এ কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের শাসনকালের চরিত্র নয়। বরং বলা যায়, বহুদিন ধরে চলতে থাকা এই সিস্টেমেরই এক ধরনের অবক্ষয়ের মুখ। সাধারণ নাগরিক হিসাবে সেই ঘুণপোকা তাড়ানোর যে বাসনা দর্শকমনে চাপা থাকে, শুভঙ্কর বা অনিমেষের চরিত্রগুলি পর্দাতে তাই-ই যেন বাস্তবায়িত করে। ফলে এই চরিত্রগুলোর আলাদা কদর থাকে দর্শকের কাছে। আর এই বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ে অনিমেষ চরিত্রটিকে যে স্বাতন্ত্র দিয়েছিলেন, তা এল লহমায় মন জয়ে করে নিয়েছিল। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রায় এক দশক পেরিয়ে অনিমেষ যখন ফিরলেন পর্দায়, তখনও মানুষ বোধহয় নানারকম সমস্যা থেকে প্রতিকারের জন্য উন্মুখ। জনমানসের সেই চাহিদাটাই পূরণ করেছেন পরিচালক। তাঁর এই সিরিজের পটভূমিকা সুন্দরবন। জল-জঙ্গল আর শ্বাপদসঙ্কুল সেই ভূমিতেই ক্রমে বেড়েছে নারীপাচারের ঘটনা। যেখানে জলে কুমির ডাঙায় বাঘ, সেখানে মানুষ তো অনেকটাই বিপদে। অতএব অপরাধ দমন করতেই পদার্পণ অনিমেষ দত্তের। এরপর ঘটনা এগিয়ে চলে তুরন্ত গতিতে। পর্বে পর্বে উন্মোচিত হতে থাকে গল্পের নানা দিক। গল্পের সেই এগিয়ে যাওয়ায় সঙ্গ দিয়েছে চমৎকার অভিনয়। ঋত্বিক চক্রবর্তী যে কত বড় মাপের অভিনেতা তা আর নতুন করে বলে দিতেহয় না। এই সিরিজেও শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হয় একটা জটিল চরিত্রের আলো-ছায়াকেও তিনি কী অবলীলায় সাবলীল করে তুলতে পারেন। ঠিক যেমন সোহিনী সেনগুপ্ত। মঞ্চের সোহিনীকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা নিশ্চয়ই তাঁকে এখানে নতুন ভাবে আবিষ্কার করবেন। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনেতাকে যত দেখা যায় বাঙালি দর্শক হিসাবে আনন্দ তত বাড়ে। সায়নী ঘোষ, গৌরব চক্রবর্তী, কৌশানী মুখোপাধ্যায়ও নিজেকে ভেঙেচুরে গড়ে নিয়েছেন। বলতে গেলে, প্রত্যেক চরিত্রাভিনেতাই নিজেদের সেরা অভিনয় উজাড় করে দিয়েছেন। ঠিক যেমন আমরা পুরনো বাংলা সিনেমায় দেখেছি। ছোট থেকে ছোট চরিত্রেও অনবদ্য প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতেন তুখড় অভিনেতারা। এই সিরিজের অভিনয়ে সেই ঘরানারই ছায়াপাত।
আরও শুনুন: হার মেনেছে শাসকের রক্তচক্ষু, জনতার ভালবাসায় চিরকালীন কিশোরের গান
গল্প চলেছে গল্পের নিয়মে। কখনও অতীত এসে মিশেছে বর্তমানে। মানুষের ভিতর যে অপরাধপ্রবণতা, প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, যৌনঈর্ষা- তা বদলে বদলে দিয়েছে গল্পের বাঁক। আর প্রতি বাঁকে গিয়ে দর্শক আবিষ্কার করেন নতুন কিছু, যা গল্পের পরবর্তী অংশের জন্য তাকে প্রলুব্ধ করে। আর এই এক্কা-দোক্কার ভিতরই পরিচালক এগিয়ে চলেন জরুরি এক প্রসঙ্গের দিকে। অপরাধ আর ধর্মের ছদ্মবেশ এসে দাঁড়ায় পাশাপাশি। ধর্মের ভেক যখন অপরাধকে চাপা দিতে সহায়ক হয়ে ওঠে, তখন অপরাধ আরও সংগঠিত ও প্রসারিত হয়। তা শুধু জনে জনে মানুষের ক্ষতি করে না, বিষিয়ে দেয় জনজীবনকেই। এ কি কেবল একজন বা দুজন চরিত্রের মানসিক অবস্থা! নাকি আমাদের সমাজের গড় একটি প্রবণতাকেই চিহ্নিত করলেন পরিচালক? দর্শক এ-প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়াতে বাধ্য হন। নারীকে কেন্দ্র করে যে ক্ষমতাদখলের যে প্রাচীন আখ্যান,পরিচালক তাই-ই অনুসরণ করেছেন। আর আমরা জানি, এই ক্ষমতার লোভ অত্যাচারের যে-ছুরি গোপন করে রাখে, তা ফালাফাল করে নারীকেই। ফলত, নারীর উপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন। নারীর উপর এই অত্যাচারই যেন একটা সময়ে ক্ষমতার বীভৎসতাকে স্পষ্ট করে। পরিচালক এই প্রসঙ্গগুলিকে কিন্তু গোপন করেননি। গোপন করেননি যুবকসমাজের বেপথে চলে যাওয়ার ভবিতব্যকেও। হয়তো দাগিয়ে বলার চেষ্টা নেই। কিন্তু ঘটনার পরত সরিয়ে চাইলে তা দেখাই যায়। অপরাধ, যা মানুষকে বিপর্যস্ত করে, তা কি ধর্মের ছদ্মবেশ দিয়ে দীর্ঘকাল গোপন রাখা যায়! মানুষ কি তা বরদাস্ত করে! অনিমেষ দত্ত নামে কোনও প্রতিষেধকে কি এই ভাইরাস দূর হয়! নাকি অপরাধের প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপই ছোবল দেয় মানবতাকে! সিরিজ তার মতো করে একটা উপসংহারে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। তবে এই ভাবনার সূত্রগুলো ছড়িয়ে দেয় দর্শকের মনে। আর সেখানেই বোধহয় এই ওয়েব সিরিজে বাজিমাত রাজের। ফলত, গল্পের ভিতর থেকে ছোটখাটো যে সব খটকা আর সংশয় ভেসে আসে, তা যেন আর খুব বেশি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না।
আরও শুনুন: সলিল চৌধুরীর গান গাইতে গিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন কিশোর কুমার, কেন জানেন?
এমন ওয়েব সিরিজ, যা সামাজিক সংকটের কথা বলেও বহু দর্শককে এক সুতোয় বেঁধে রাখতে পারে, তা ইন্ডাস্ট্রির পক্ষে স্বাস্থ্যকরই বলা যায়। বাংলা সিনেমার ব্যবসাপত্তরের হালহকিকত নিয়ে নানা সময়েই আলোচনা হয়। সেই নিরিখে বলা যায়, রাজ চক্রবর্তী স্বধর্মই পালন করেছেন। বহু সংখ্যক দর্শককে স্ক্রিনমুখী করার দায়িত্ব যদি পরিচালকের হয়, তবে এ সিরিজে তিনি তা ভালভাবেই পালন করেছেন বলা যায়। আর শুধু বিনোদন ফেরি করেই ক্ষান্ত হননি। সিরিজে এক পুলিশকর্মীর মুখে একটি সংলাপ আছে- হ্যালো স্যার। চরিত্রটি মজার। সিরিজ যত এগোয় চরিত্রটির উত্তরণ ঘটে। এই সিরিজের প্রকৃতিও সেরকমই। যত এগিয়েছে সাদামাটা ঘটনা থেকে তা অন্য মাত্র স্পর্শ করার চেষ্টা করেছে। বলা যায়, ওই চরিত্রের মতোই, দর্শকের ভাবনায় টোকা মেরে পরিচালকও যেন নেপথ্যে বলে উঠেছেন- হ্যালো স্যার। দর্শক কতটা ভাবিত হবেন, আর কতখানি বিনোদন হিসাবেই নেবেন এই সিরিজকে, তা তো একান্তই ব্যক্তিগত অভিরুচি। তবে এমন সিরিজ বাংলায় হলে যে আখেরে লাভ ইন্ডাস্ট্রির, দর্শকেরও।