রাত ৯টা ৩২-এ প্রয়াত হন উত্তমকুমার। ভবানীপুরের বাড়িতে, মরদেহ আনা হয়েছিল তাঁর প্রিয় অ্যাম্বাসাডরে করে। পাশে বসে অঝোরে কাঁদছিলেন সৌমিত্র। আর আক্ষেপ করে বলে উঠেছিলেন, মৃত্যু, নাকি সুইসাইড? মহানায়কের শেষযাত্রার সেই কাহিনিই শোনালেন সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেটা ছিল ১৯৭৮ সালের শেষের দিক। স্টুডিওপাড়ায় ক্রমাগত লোডশেডিং-এর ফলে শুটিং বিঘ্নিত হওয়ার কারণে মহাকরণে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং উত্তমকুমার।
গাড়িতে যেতে যেতে উত্তম বললেন, “মানিকদা, আপনি কিন্তু আমাকে আর নিচ্ছেন না।”
সত্যজিৎ বললেন, “দ্যাখো উত্তম, তোমার বয়সটা এখন এমন, তুমি না বুড়ো না জোয়ান- আরেকটু বুড়ো হলে তোমাকে নেব।”
আরও শুনুন: অলৌকিক সন্ন্যাসীর দেখা পেলেন হতাশ যুবক, বাঙালি পেল তার চিরকালের উত্তমকুমার
উত্তম বললেন, “বুড়োর পার্ট আর করা হবে না আমার, ওসব পুলুই করবে।” পুলু ছিল সৌমিত্রর ডাকনাম।
এই ঘটনার কথা উল্লেখ করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “উত্তমদা যেটা বলল সেটাই সত্যি হয়ে গেল। আশ্চর্য! উত্তমদা যেন মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল। প্রায়ই বলত, আর ভাল্লাগছে না রে! আর ভাল্লগাছে না!”
কলকাতায় মেট্রো চালু হয় আটের দশকের মাঝামাঝি। ‘৭৮- ‘৭৯ সাল নাগাদ মেট্রোর জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, রাস্তাঘাটে প্রাণান্তকর অবস্থা। এমনই একদিন জ্যামে দাঁড়িয়ে আছেন উত্তমকুমার। গাড়িতে সঙ্গে রয়েছেন এক সহশিল্পী। সে বলল, “দাদা, মেট্রো যখন চালু হবে তখন কলকাতার চেহারাটাই পালটে যাবে।” উত্তম একটা অদ্ভুত উত্তর দিয়েছিলেন। “ওসব আর আমার দেখা হবে না রে! ওসব তোরাই দেখিস।”
আরও শুনুন: গুন্ডাদের চোখে চোখ রেখে এগোলেন উত্তমকুমার, তারপর…
গিরিশ মুখার্জি রোড আর ময়রা স্ট্রিট, এই দুই বাড়ির টানাপোড়েন আর ঝগড়ায় জেরবার হয়ে গিয়েছিলেন উত্তম। ঘনিষ্ঠদের কাছে মাঝেমধ্যেই বলতেন, “এবার একা থাকব। কিচ্ছু ভাল্লাগছে না!” অভিনেতা রবি ঘোষ একাব্র লিখেছিলেন উত্তমকুমার সম্পর্কে, যে- “উত্তমকুমার এত বড় নায়ক, লক্ষ কোটি তার গুণমুগ্ধ ভক্ত, সবাই তাকে ভালবাসে, তাকে ছুঁতে চায়। কিন্তু উত্তম? অবাক হয়ে দেখতাম, উত্তম যখন একবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি হল, তখন সারাদিন চাতক পাখির মতো চেয়ে বসে থাকত কখন মা আসবেন তাকে দেখতে। সেই আকুলতা দেখে মনে হত মানুষটা বড় অসহায়। জগৎসংসারে যেন কেউ নেই, এমন যাকে ভরসা করা যায়, বিশ্বাস করা যায়।”
উত্তমকুমার যেদিন মারা গেলেন, সেই রাতেই কী ভিড় জমে গেল কলাকুশলী আর অসংখ্য গুণমুগ্ধ মানুষের! সেখানে, সেই অসংখ্য মানুষের ভিড়ের মধ্যেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। “বুড়োদা, ও মুখ আমি কেমন করে দেখব গো! এ তো ক্যালকুলেটিভ সুইসাইড! যার হার্টের অবস্থা ভাল না, যার রেস্ট প্রয়োজন, সে রাত দুটো পর্যন্ত মদ খায়, পার্টিতে হইহই করে সব জেনেশুনে? উত্তমদা এ কী করল?”
২৩শে জুলাই শুটিং থেকে ফিরে উত্তম গিয়েছিলেন প্রযোজক দেবল ঘোষের নতুন ফ্ল্যাটে গৃহপ্রবেশের পার্টিতে। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে মদ্যপান করেন। ফেরেন ভোররাতে। ২৪শে জুলাই সকাল সাড়ে পাঁচটা কি ছটা নাগাদ সুপ্রিয়া-কন্যা সোমার সঙ্গে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে উত্তম খুব ঘামছিলেন।
সোমা বললেন, “বাবি, তুমি খুব ঘামছ!”
উত্তম বললেন, “হুম। বুকেও একটু চিনচিন করে ব্যথা করছে। আমি বরং একটু বেলভিউ থেকে ঘুরে যাই।”
এই বলে উত্তম হেঁটে হেঁটেই বেলভিউ পৌঁছে যান।
আরও শুনুন: মুখে আনন্দধ্বনি ‘হরি-বোল’, উত্তম-অভিনয়ের পথে মিশেছিল শ্রীরামকৃষ্ণের বাণীও
রাত ৯টা ৩২-এ মারা যান উত্তমকুমার। ভবানীপুরে তাঁর বাড়িতে, তাঁর মরদেহ আনা হয়েছিল তাঁর প্রিয় অ্যাম্বাসাডরে করে। পেছনের সিটে তাঁকে শোয়ানোর পর পা দুটো বেরিয়েছিল। তাঁর ভাই তরুণকুমার রীতিমতো জোরে আঘাত করে সেই পা দুখানি মুড়ে গাড়ির ভেতরে ঢোকান, না হলে গাড়ির দরজা বন্ধ হচ্ছিল না।
উত্তমকুমারের শেষ ডায়েরিটির পাতাগুলোয় দেখা যাবে, সবুজ কালি দিয়ে ২৩, ২৪, ২৫ জুলাই, ১৯৮০-এর পাতায় লিখে রেখেছেন- “ডাবিং ওগো বধূ” আর ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমাটির নাম কাটা। ২৬ জুলাই থেকে পরপর কটা পাতায় লেখা, ‘রেস্ট’! চিরবিশ্রাম! কে জানে, তিনি হয়তো তাই চেয়েছিলেন!