লোকসভার আগে অযোধ্যায় প্রতিষ্ঠা হয়েছে রামমন্দির। গর্ভগৃহে অবশ্য শুধুই রামলালা, সীতার মূর্তি নেই। অথচ এমনও এক রামায়ণ রয়েছে যেখানে, যিনি রাম তিনিই সীতা। রামমন্দির প্রতিষ্ঠার অন্তত ১০০ বছর আগে এমন রামায়ণ দেখেছিল দেশবাসী। কোন রামায়ণের কথা বলছি? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
রামমন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে দেশজুড়ে রীতিমতো চর্চা চলেছিল। যার প্রভাব পড়েছিল বলিউডেও। একের পর এক পরিচালক রামায়ণ তৈরিতে মজেছিলেন। সবই যে প্রশংসা কুড়িয়েছে তা নয়। বরং রামায়ণের কাহিনি নির্ভর ছবি ‘আদিপুরুষ’ নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছিল। তার সঙ্গে তুলনা টেনে রামানন্দ সাগর পরিচালিত দূরদর্শনের রামায়ণ চর্চায় ফিরেছিল। অনেকেই এই রামায়ণকেই মহাকাব্যের প্রথম চলচিত্রায়ন মনে করেন। তবে আসলে তা একেবারেই নয়। প্রায় ১০৭ বছর আগে রামায়ণ নিয়ে সিনেমা তৈরি করেছিলেন দাদা সাহেব ফালকে।
সাহিত্য হোক বা সিনেমা, রামায়ণ নিয়ে চর্চা নতুন নয়। হিন্দি, সংস্কৃত, বাংলার মতো উর্দুতেও রামায়ণ অনুবাদ হয়েছে। বিভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে রামায়ণের কাহিনিও। তবে রাবণ বধ করে সীতা উদ্ধার কাহিনিটাই প্রচলিত। সিনেমা বা সিরিয়ালেও সেই কাহিনিই দেখানো হয়। প্রথমবার যা দেখিয়েছিলেন দাদা সাহেব ফালকে। ভারতীয় সিনেমার জনক হিসেবে তাঁকেই মনে করা হয়। যদিও এই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে দাদা সাহেব ফালকে যে ভারতীয় সিনেমার প্রাণপুরুষ এ কথা বলাই যায়। সে যুগের সিনেমা মানেই সাদাকালো। এমনকি কোনও ভিএফএক্স, স্পেশাল এফেক্ট কিচ্ছু নেই। স্রেফ নিখাদ অভিনয়ের জোরেই দর্শকদের মন ছুঁয়েছিল এই সিনেমা। নাম অবশ্য রামায়ণ রাখা হয়নি। মূলত রামায়ণের একটা অংশ নিয়ে তৈরি এই সিনেমার নাম ছিল লঙ্কাদহন। তবে এই সিনেমা দর্শকদের মনে অন্য মাত্রায় প্রভাব ফেলেছিল। অবশ্যই ধর্মের আঙ্গিকে। শোনা যায়, দর্শকরা সিনেমা হলে আসতেন শুদ্ধাচারে। যেন মন্দিরে পা রাখছেন, এই ভেবে কেউ জুতো অবধি পরতেন না। স্ক্রিনে রামকে দেখালেই কপালে হাত ঠেকাতেন। বিভিন্ন দৃশ্যে উচ্চসিত হয়ে রামের নামে জয়ধ্বনি দিতেন কেউ কেউ। সব মিলিয়ে সিনেমা হিসেবে লঙ্কাদহন যেমনই হোক, ধর্মের ভাবাবেগে নাড়া দিয়েছিল এই সিনেমা।
তবে ১৯১৩ সালে এই সিনেমা তৈরি করা মোটেও সহজ ব্যাপার ছিল না। মহাকাব্যে এমন অনেক দৃশ্য রয়েছে যা কারিগরি দক্ষতা ছাড়া দেখানো সম্ভব নয়। তা সে হনুমানের ল্যাজে আগুন ধরানো হোক আবার রাম-রাবণের যুদ্ধ! কোনওটাই সাধারণভাবে দেখানো সম্ভব নয়। তাই এক্ষেত্রে নাটকে যেমনটা করা হয়, অর্থাৎ প্রতীকী ভাবেই যুদ্ধ কিংবা কারও মৃত্যু দেখানো হয়েছিল। তবে এই সিনেমা তৈরি করতে পরিচালক অন্য এক সমস্যায় পড়েছিলেন। হাজার খুঁজেও সীতার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কাউকে পাননি তিনি। আসলে সে যুগে মহিলাদের অনেক বিধিনিষেধ মেনে চলতে হত। অভিনয়ের ক্ষেত্রেও ছিল কড়া নিষেধাজ্ঞা। এদিকে সীতা ছাড়া রামায়ণ হবে কীভাবে? বাধ্য হয়েই, পুরুষ অভিনেতাকে সীতা সাজিয়ে অভিনয় করান পরিচালক। অদ্ভুতভাবে সেই অভিনেতাই রামের চরিত্রে অভিনয় করেন। এ জিনিস আর কোথাও হয়নি বললে ভুল হয় না। তাও দর্শকরা এতটুকু অবাক হননি। সবাই সহজভাবে সবটা মেনে নিয়ে সিনেমাটি উপভোগ করেছিলেন। এইসময় বেশ জনপ্রিয়তা পেলেও কালের গর্ভে হারিয়ে যায় লঙাদহন-এর মতো সিনেমা। তবে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম অংশ হয়ে থেকে যাবে এই সিনেমা।