সিনেমা আর বাস্তবে প্রায়শই কথা চালাচালি হয়। আর তাই কোনও কোনও সংলাপ সময়ের প্রেক্ষিতে আলাদা মাত্রা পেয়ে যায়। সাম্প্রতিক এই সংলাপ যে এতখানি গুরুত্ব পেল, তা থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট হয় যে, তা শুধুমাত্র সিনেমার চিত্রনাট্যে আটকে নেই।
‘বেটেকো হাত লাগানে সে পহলে বাপ সে বাত কর্’- পর্দায় রীতিমতো ঠান্ডা গলায় হুঙ্কার দিচ্ছেন ‘জওয়ান’ শাহরুখ খান। আর তাতেই গোটা হল ফেটে পড়ছে হাততালিতে। নেহাত কি এক ‘হিট’ ডায়লগ! চিত্রনাট্যের গুণে দর্শকের মনে দাগ কেটে গিয়েছে? তা হলে তো হয়েই যেত। আসলে এই একটি সংলাপের দরজা দিয়ে সিনেমা আর বাস্তব যেন মিলেমিশে গিয়েছে। পর্দার ‘জওয়ান’ আর বাস্তবের শাহরুখ খান যেন হাত ধরাধরি করেছেন এই এক সংলাপেই। আর তাই ভারতবর্ষের বাণিজ্যিক সিনেমার ইতিহাসে এই সংলাপের গুরুত্ব নিশ্চিতই অন্য মাত্রার। তবে, সম্প্রতি এক নয়া বিতর্কের চোরাস্রোতে পড়ল সংলাপটি। অভিযোগ উঠল, এই সংলাপ ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী।
সিনেমা বাস্তবের হুবহু অনুলিপি নয়। বাস্তবের গণ্ডি কাটাতে পারে বলেই তার আবেদন এমন সর্বজনীন। তবে, সিনেমা তো বাস্তবরহিত নয় মোটেও। মোটের উপর বাস্তবের সঙ্গে সমঝোতা করেই তা গড়ে তোলে নিজেকে। আর সেই সমঝোতা যত পোক্ত হয়, তত সিনেমা দর্শকমনে উপর প্রভাব ফেলে। একেবারে তোলা থাকে স্মৃতির সিন্দুকে। তবে এই চুক্তিপত্রে কখনও সখনও বেশ আশ্চর্য ফাঁকফোকর দেখা যায়। যেখানে সিনেমার বাস্তবতায় এমনভাবে জড়িয়ে যায় মাটির বাস্তব, যে, দুটিকে পৃথক করা যায় না কিছুতেই। অমিতাভ বচ্চনের ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ ইমেজ আর সত্তরের ভারতবর্ষের রাজনীতির নিহিত অস্থিরতাকে যেভাবে আলাদা করা যায় না, সেরকমই। সাম্প্রতিক ‘জওয়ান’ সিনেমার এই সংলাপটিকে সেরকম একটি নমুনা হিসাবেই দেখা যায়।
সংলাপটি আগাগোড়া চিত্রনাট্যে ছিল, নাকি পরে যোগ হয়েছে, তা জানা নেই। তবে, যখন এ ছবি মুক্তি পেল, অর্থাৎ দর্শক এই সংলাপ শুনল তখন শাহরুখ খানের জীবনে ঘটে গিয়েছে এক পর্বান্তর। মাদক রাখার অভিযোগে জেলে থাকতে হয়েছে তাঁর ছেলেকে। সেই সময় বাবা হিসাবে শাহরুখের লড়াইয়ের সাক্ষী থেকেছে গোটা দেশ। তাঁর অনুরাগীরাও। সেই পর্বে অনেকেই বলেছিলেন যে, ছেলে আরিয়ান নয়, আসলে এই হেনস্তার লক্ষ্য শাহরুখ খান স্বয়ং। কিন্তু এই বক্তব্যের সারবত্তা বিশেষ পাওয়া যায় না। ঘটনার জল গড়াতে থাকে। এক সময় অভিযোগ থেকে মুক্তি পান শাহরুখের ছেলে আরিয়ান খান। আর ঠিক তার পরেই পর্দায় নায়ক শাহরুখকে বলতে শোনা গেল- ‘বেটেকো হাত লাগানে সে পহলে বাপ সে বাত কর্’। এরপর আর সিনেমা আর বাস্তবকে মেলাতে দ্বিধা করেননি শাহরুখ ফ্যানরা। সংলাপটির মধ্যেই যেন সেই ইঙ্গিত রাখা ছিল। অনেকেই ধরে নিয়েছেন, এ কথা যত না সিনেমার ভিলেনকে বলা, তার থেকেও বেশি যেন বলা তখনকার নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর প্রাক্তন কর্তা সমীর ওয়াংখেড়ের উদ্দেশ্যে। শাহরুখ এ সংলাপ বলেওছিলেন সরাসরি ক্যামেরায় তাকিয়ে, অর্থাৎ সিনেমা পেরিয়ে সে সংলাপ যে বাস্তবের জমিতে এসে পড়বে, সেই ব্যবস্থা যেন করাই ছিল। বাস্তবিক হয়েওছে তাই।
সম্প্রতি তা নিয়ে মুখ খুলেছেন সমীর ওয়াংখেড়ে স্বয়ং। তাঁর কাছে এই সংলাপ খুব খাজা, সস্তা বলেই মনে হয়েছে। তবে, আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর মতে, এই সংলাপ ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। ভারতীয়রা এভাবে কথা বলেন না, এইরকম শব্দ প্রয়োগ করেন না বলেই দাবি তাঁর। তাঁর বক্তব্যের ভিতর অন্য একটি ইঙ্গিতও রাখা আছে। তা হল, শাহরুখ সিনেমাকে বাস্তবের জবাব দেওয়ার মঞ্চ হিসাবে বেছে নিয়েছেন। আর তাই এরকম কথা উঠে এসেছে তাঁর সংলাপে, যা নিম্নরুচির বলেই মত তাঁর। তিনি রুচির এই নিম্ন স্তরে নামতে চান না বলেও জানিয়েছেন সমীর।
সিনেমা আর বাস্তবে প্রায়শই কথা চালাচালি হয়। আর তাই কোনও কোনও সংলাপ সময়ের প্রেক্ষিতে আলাদা মাত্রা পেয়ে যায়। সাম্প্রতিক এই সংলাপ যে এতখানি গুরুত্ব পেল, তা থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট হয় যে, তা শুধুমাত্র সিনেমার চিত্রনাট্যে আটকে নেই। সিনেমার ছায়া এভাবে প্রসারিত হতেই পারে। তবে, সমীরের অভিযোগও একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। বাস্তবকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে সংস্কৃতির পরিপন্থী কোনও সংলাপের অবতারণা করা যায় কি! যদিও শাহরুখের এই ডায়লগ নিয়ে প্রথমবার এমন অভিযোগ উঠল, তবে ভাবনার অবকাশ কিন্তু থেকেই যায়।