অস্কারে ভারতের আশা ‘লাপাতা’, দৌড় থেকে ছিটকে গিয়েছে কিরণ রাওয়ের ছবি। আর তারপরই ভারতীয় চলচ্চিত্রমহলে একটাই প্রশ্ন, প্রতিবার একই ভুল হয় কী করে? তা নিয়েই জমে উঠেছে বিতর্ক। আসুন কান পাতা যাক।
‘মাদার ইন্ডিয়া, ‘সালাম বম্বে’ এবং ‘লগান’। আলাদা আলাদা দশকের তিন ছবির মধ্যে যোগসূত্র একটাই। তিনটে ছবিই অস্কারে সেরা ছবির বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিল। তার পর থেকে ক্রমাগত ভুল আর ভুল। প্রতিবারই অস্কারের জন্য ভারতের তরফ থেকে যে ছবিটিকে বাছা হয়, তা খানিকটা এগিয়ে ছিটকে যায়। তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে প্রশ্ন ওঠে যে, যে ছবিটিকে পাঠানো হয়েছিল, তার থেকে ভাল ছবি দেশে তৈরি হওয়া সত্ত্বেও পাঠানো হয় নাকেন? এই বিতর্ক যেন একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ‘লাপাতা লেডিস’ দৌড় থেকে ছিটকে যেতেই প্রশ্ন উঠেছে পায়েল কাপাডিয়ার ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ ছবিটিকে কেন বাছা হল না! এই নিয়েই নানা মুনির নানা মত। তবে, সারকথা একটাই যে, তাতে ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিশেষ কিছু লাভ হচ্ছে না। যা হচ্ছে, তা অনর্থক তর্ক মাত্র।
যে ছবি বাছা হবে তা যে শেষ পর্যন্ত বাজিমাত করবে, এমন কোনও কথা নেই। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’, ‘মহানগর’ থেকে শুরু করে এম এস স্যাথুর ‘গরম হাওয়া’ বা শ্যাম বেনেগালের ‘মন্থন’-এর মতো সিনেমার কথা উদাহরণ হিসাবে টানা যায়। তবে তখন এমন বিতর্ক তৈরি হয়নি যে, যে সিনেমা পাঠানোর কথা তা পাঠানো হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, অন্তত সাতের দশক পর্যন্ত এই তর্কের অবকাশ সেভাবে ছিল না। তার পর থেকে পরিস্থিতি ক্রমশ বদলাতে থাকে। এবং গত কয়েক বছরে বারবার একই প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৩ সালের কথাই ধরা যাক। ভারতের তরফ থেকে ‘দ্য গুড রোড’ ছবিটিকে অস্কারের দৌড়ে পাঠানো হয়। সে বছর অনেকেই বলেছিলেন ইরফান খান অভিনীত ‘লাঞ্চবক্স’ আরও যোগ্য ছবি ছিল এই ক্ষেত্রে। কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি প্রশংসা অর্জন করেছিল। একই প্রশ্ন উঠেছিল ঠিক তার আগের বছর অনুরাগ বসুর ‘বরফি’ ছবিটির নির্বাচন নিয়ে। এমনকী গত বছর রাজামৌলির ‘আরআরআর’ ছবিটি যখন এই বিভাগে নির্বাচিত হল না, তখনও অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
উদাহরণ অনেক আছে। তবে অসুখ একটাই। সিনে-বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, কোথাও একটা ছবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভুল হয়ে যাচ্ছে। আর তাই প্রতিবারই বিমুখ হতে হচ্ছে ভারতকে। এমন নয় যে, যে ছবিটি বাছা হয়েছে, তার পরিবর্তে অন্য ছবি বাছলেই বাজিমাত হত। তবে, এই যে যোগ্য ছবি থাকা সত্ত্বেও না পাঠানোর অভিযোগ, সেটুকু অন্তত থাকত না। এবারেও যখন একই প্রশ্ন উঠলে, সাফাই দিতে হয়েছে ফিল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার জুরি প্রধানকে। তাঁর বক্তব্য, সকলেরই মনে হয়েছিল যে ‘লাপাতা লেডিস’ ছবিটির মধ্যে সেই সব বিষয় আছে, যা বিশ্বের সিনেপ্রেমীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত। যে সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি আমাদের হতে হচ্ছে, তাই-ই ফুটে উঠেছিল এ ছবিতে, এমনটাই তাঁর অভিমত। তবে কোথাও যে একটা সমস্যা ছিল, তাও অস্বীকারের কোনও জায়গা নেই। আর এখানেই উঠেছে ‘লবি’র প্রশ্ন। সদ্য এ নিয়ে মুখ খুলেছেন বর্ষীয়ান শিল্পী অমল পালেকর। সরাসরি কারও নাম তিনি উল্লেখ করেননি, তবে সুপারস্টারদের চাপ যে থাকে, তা খোলসা করে দিয়েছেন। ২০১৫ সালে তিনি এই নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন। সে বছর আমির খানের ‘পিকে’ ছবিটি নির্বাচিত হবে এমনটা অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন। যদিও সে বছর ‘কোর্ট’ ছবিটিকে এই দৌড়ের জন্য বেছেনেওয়া হয়েছিল। অনেকেই মনে করছেন, ঘুরিয়ে আমির খানের লবি করার প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন বর্ষীয়ান অভিনেতা।
লবি যার-ই থাকুক, আর ব্যর্থ হওয়ার পর যে সাফাই দেওয়া হোক না কেন, দেশের হাতে কিন্তু শূন্যই থাকে। কোন ছবি অস্কার পাবে, তা আলাদা বিষয়। তবে ভালো ছবি থাকতেও অন্য ছবিকে নির্বাচন করা হচ্ছে, এই অভিযোগ মোটেও দেশের সিনেমার জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। অভিযোগ, পালটা অভিযোগ ভুলে সেদিকেই এখন নজর ফেরানো একান্ত জরুরি।