কেরিয়ার না ব্যক্তিজীবন! সাফল্যের সিঁড়িতে চড়তে চড়তে এই দুয়ের ভারসাম্য বজায় রাখতে অনেকেই বেসামাল হয়ে পড়েন। আবার চূড়ান্ত সফল ব্যক্তিরা দুদিকই সামলাতে পারেন দক্ষতার সঙ্গে। সেই সফল ব্যক্তির নাম যদি হয় শাহরুখ খান, আর ব্যক্তিজীবন আর কেরিয়ারের মধ্যে যদি তাঁকে কোনও একটা বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে তিনি কোনদিকে ঝুঁকবেন? মন খুলে সেই উত্তর দিয়েছিলেন বলিবাদশা। আসুন শুনে নিই।
আট থেকে আশি! তাঁকে দেখলেই ভক্তদের হৃদয়ে ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’। তবে মহিলা ভক্তদের কথা আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়। বলা যায় শাহরুখকে দেখলেই তাঁদের ‘দিল তো পাগল হ্যায়’। পর্দায় দেখা হোক বা পর্দার বাইরে, শাহরুখ খান হলেন মহিলা ভক্তদের হৃদয়ের বাদশা।
আরও শুনুন: ‘দ্বেষের দেশ’ ভোলাল ‘পাঠান’, বয়কট-ড্রাগ পেরিয়ে পর্দায় যেন ভারত-জোড়ো শাহরুখের
জনপ্রিয় সিনেমার চরিত্র নিয়ে যাঁরা চর্চা করে, তাঁরা এর অনেকগুলো কারণও চিহ্নিত করেছেন। দেখা গিয়েছে, শাহরুখের অভিনীত চরিত্র সামাজিক অনুশাসনকে খুব বেশি অগ্রাহ্য হয়তো করতে পারে না; তবে তারা যে পুরুষতন্ত্রের তীব্র প্রতীক- এরকমটাও নয়। বরং তথাকথিত ম্যাসকুলিনিটি বিপ্রতীপে দাঁড়ানো চরিত্র হয়েই ধরা দিয়েছে পর্দার রাহুল-রাজ। যারা মহিলাদের সম্মান করে শুধু নয়, তাদের অনুভব-অনুভূতিকেও গুরুত্ব দেয়। যে সমস্ত কাজ মহিলাদের বলে অলিখিত নিয়ম তৈরি করে দিয়েছে সমাজ, যেন পুরুষদের সে কাজ করতেই নেই, সেইসব কাজই অবলীলায় করতে শুরু করে দেয় শাহরুখ অভিনীত পর্দার চরিত্ররা। হয়তো মহিলাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে আনাজ কাটছেন, কিংবা কোনও একজন মহিলা চরিত্রের কাজকে নিজের কাঁধে নিয়ে নিচ্ছেন- এরকমই ছোট ছোট বিষয়ে শাহরুখের পর্দার ইমেজ হয়ে উঠেছে মহিলাদের খুব কাছের একজন, যাকে আপনজন ভাবা যায়। সিনেমা নিয়ে চর্চাকারীরা আরও উল্লেখ করেছেন, শাহরুখের পর্দার চরিত্ররা আগ্রাসী ভাবে তার নায়িকাকে শারীরিক ভাবে দখল করতে চায় না। যা একরকমের নিরাপত্তা দেয় নারী দর্শকমনে। হয়তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাহরুখের চরিত্ররা, উলটোদিকের নারীচরিত্রের ঠোঁটে নয়, বরং ঘাড়ে কিংবা কপালে আলতো চুম্বন এঁকে দিচ্ছে। পপুলার সিনেমায় নারীচরিত্রকে যেভাবে তৈরি করা হয়, তা শেষ পর্যন্ত পুরুষ চরিত্রটির দখলেই যায়। এইসব সিনেমা হয়তো তার ব্যতিক্রম নয়, কিন্তু সামগ্রিক কাজকর্মে ব্যতিক্রমের খানিক আভাস থাকে। যা মহিলাদের কাছে পর্দার শাহরুখকে জনপ্রিয় করে তুলেছে।
আরও শুনুন: ‘বয়কট গ্যাং’-এর সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে জয়, কোন মন্ত্রে হাসিল শাহরুখের?
শাহরুখ নিজেও এই বিষয়টি নিয়ে একবার মুখ খুলেছিলেন। বলেছিলেন, একটা প্রেমের গল্প তখনই সফল হয়, যখন তা মহিলাদের অনুভূতি বা ইমোশনকে গুরুত্ব দেয় অর্থাৎ ‘এমপাওয়ার’ করে। শুধু ‘উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট’-এর কথা তিনি বলেননি, বলেছিলেন, নারীর ইমোশনের এমপাওয়ারমেন্টের কথা। ধরা যাক, প্রিয় পুরুষের জন্য করবা-চওথ ব্রত করেছেন কোনও মহিলা। পুরুষটিও পালটা সেই ব্রত করলেন। এর মানে এই নয় যে, মেয়েটি খালি পেটে থাকছে বলে পুরুষটিও খালি পেটে থাকছে। কিন্তু এই যে মেয়েটির আবেগকে গুরুত্ব বা মর্যাদা দিচ্ছে তাঁর পুরুষটি, সেটাই বাড়তি কিছু মাত্রা যোগ করে। আর তাই তাঁর বিশ্বাস, রোম্যান্টিক পুরুষ চরিত্রদের জন্য পর্দায় প্রেমের সিনেমা হিল্লোল তোলে না। বরং সেই চরিত্ররা যখন নারীর অনুভূতিকে মর্যাদা দেয়, তখনই সফল হয়ে ওঠে সার্থক প্রেমের কাহিনি।
পর্দার বাইরে ব্যক্তিজীবনেও শাহরুখ এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন। তাঁর নায়িকাদের তো বটেই, এমনকী সুপারস্টার হয়েও তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে যেভাবে গুরুত্ব দেন, তা প্রায় কিংবদন্তির পর্যায়ে। অনেকেরই হয়তো খেয়াল থাকবে, একটি অনুষ্ঠানে এগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন গৌরী খান। খেয়াল করেননি যে, তাঁর পোশাকের একটা অংশ মাটিতে লুটোচ্ছে। খোদ শাহরুখ সেই পোশাক তুলে ধরে স্ত্রীর পিছু পিছু এগোচ্ছিলেন। অথচ আশেপাশে লোকজনের অভাব ছিল না। তাঁরাই এই কাজ করতে পারতেন, কিন্তু পর্দার সুপারস্টার ধরা দিলেন মাটির মানুষ হয়ে। বাদশার এই কাজ এক লহমায় মন কেড়েছিল ভক্তদের। শুধু ক্যামেরার সামনে বা পাবলিক ফাংশনেই তিনি যে এ কাজ করেছিলেন তা নয়। বহুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি সাফ জানিয়েছিলেন তাঁর জীবনদর্শন। বলেছিলেন, ‘যদি আমাকে কেউ প্রশ্ন করেন যে, গৌরী আর কেরিয়ারের মধ্যে কোনও একটিকেই বেছে নিতে হবে, তাহলে আমি অবলীলায় সিনেমা ছেড়ে দিতে রাজি। ওর জন্য আমি সবকিছু করতে পারি, গৌরীই আমার কাছে সবকিছু।’ সেটা ১৯৯২ সাল । ততদিনে ‘দিওয়ানা’ মুক্তি পেয়েছে, ‘চমৎকার’, ‘দিল আসনা হ্যায়’ বা ‘রাজু বন গেয়া জেন্টেলম্যান’-এর দৌলতে ততদিনে বলিউডে সাড়া ফেলে দিয়েছেন শাহরুখ। সাফল্যের সেই সিঁড়িতে দাঁড়িয়েও তিনি কেরিয়ারের ঊর্ধ্বে ব্যক্তিজীবনকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
আরও শুনুন: ফ্যানের কীর্তি! মৃত্যুর আগে ৭২ কোটি টাকার সম্পত্তি সঞ্জয় দত্তের নামে উইল মহিলার
তিন দশক পেরিয়ে তিনি যখন বলিউডের একচ্ছত্র সম্রাট, তখনও এই একটি বিষয়ে এতটুকু বদলাননি তিনি। সাফল্য তাঁকে ব্যক্তিজীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়নি। বরং দেশের অন্যতম সফল মানুষ হয়েও আজও পরিবার, পরিজনকেই সবথেকে গুরুত্ব দেন শাহরুখ খান। কেরিয়া আর জীবনের দু-নৌকায় পা দিয়ে অনেকেই হয়তো বেসামাল হয়ে পড়েন। শাহরুখ খানের এই মন্ত্র হয়তো সেই বেসামাল জীবনে হয়ে উঠতে পারে অবলম্বনের দিশা।