শুধু ধর্ষণই নয়, কথায় বার্তায় ধর্ষণের হুমকি। ধর্ষণ সংস্কৃতির সঙ্গে নিত্যদিনের লড়াই মেয়েদের। নারী নির্যাতন নিয়ে প্রতিবাদের আবহে সেই ধর্ষণ-সংস্কৃতি নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে বটে। তবে হিন্দি সিনেমাতেও এই সংস্কৃতি যেভাবে বয়ে চলেছে, তার চোখ খুলবে কি?
বাগে না পেলেই নারীকে ধর্ষণের ভয় দেখানো পিতৃতন্ত্রের চেনা অভ্যাস। আজকের সমাজে দাঁড়িয়ে ‘রেপ থ্রেট’ বিষয়টি তো কোনও নারীর কাছেই অচেনা নয়। কোনও মেয়েকে গালি দিতে গিয়ে অনায়াসে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে বসে কোনও পুরুষ। কোনও মেয়ে প্রতিবাদে গলা চড়ালেও একইভাবে হুঁশিয়ারি আসে। কারও পোশাক পছন্দ নয়, কারও নিজের মতো চলায় আপত্তি, সব ক্ষেত্রেই মেয়েদের ‘সবক’ শেখানোর অস্ত্র হিসেবে আসে ধর্ষণের হুমকি। কোনও একটি নারকীয় ধর্ষণের পর তা নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, কিন্তু দেশজুড়েই এই যে ধর্ষণ সংস্কৃতি বয়ে চলেছে, তার শিকড় আরও অনেক গভীরে। এমনিতেও চলতি কথাবার্তা থেকে গালির মধ্যে অবৈধ সঙ্গমের ইঙ্গিত যেভাবে পুরে দেওয়া হয়, তাও একরকম করে ধর্ষণ সংস্কৃতির শরিক হয়ে থাকে। তবে নারী নির্যাতন নিয়ে প্রতিবাদের আবহে সেই ধর্ষণ-সংস্কৃতি নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে বটে। সামগ্রিকভাবেই মেয়েদের প্রতি জারি থাকা এই আক্রমণ নিয়ে কথা উঠছে। কিন্তু এই অভ্যাসটিকেই বলিউড সিনেমা যেভাবে আত্মস্থ করেছে, এবং তা ছড়িয়ে দিচ্ছে গোটা দেশের মধ্যে, সেই ট্রেন্ডে বদল আসবে কি?
আরও শুনুন:
যৌন হেনস্তা, তবু মুখ খুলতে ভয় মেয়েদের… ‘দহন’ চিনিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ
টিআরপি-কে গুরুত্ব দেওয়া বলিউড জানে, সিনেমা চলার জন্য নারীশরীরকে পণ্য করা তার কাছে জরুরি। কিন্তু নায়িকাকে কতখানি খোলামেলা দেখানো যাবে তার একটা গণ্ডি টানা আছে সবসময়েই, কেন-না ভালো মেয়েদের তো ‘নামিয়ে চক্ষু, মাথায় ঘোমটা টেনে’ চলতে হয়। সেখানে নায়িকার উপর জোর ফলানোর চেষ্টা করছে খলনায়ক, এমনটা দেখালে এক ঢিলে দুই পাখি মারা চলে। বস্তুত নায়ক আর খলনায়কের লড়াই আর তার মাঝখানে নায়িকার বিপন্নতার গল্প বুনে দীর্ঘদিন ধরে এই কাজটিই করে আসছে হিন্দি সিনেমা। টিভিতে তুমুল জনপ্রিয় রামায়ণ-মহাভারত ধারাবাহিক দুটিও সেই ছক ব্যবহার করেছিল নিজেদের মতো করে। শূর্পণখার স্তন কেটে দেওয়া, সীতাকে হরণ করতে গিয়ে রাবণের জোর খাটানো, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মতো দৃশ্যগুলি সম্প্রচারের সময় কীভাবে টিভির সামনে ভিড় জমত, অনেকের স্মৃতিচারণেই সে কথা শোনা যায়। নায়িকাকে দুষ্কৃতীদের হাতে বিপন্ন অবস্থায় ফেলে দিয়ে মেল গেজ-কে তুষ্ট করা, আর বিপন্ন নারীকে উদ্ধার করে পুরুষের রোমান্টিক সুখ পাওয়া- দুই-ই একসঙ্গে ঘটাতে গিয়ে ধর্ষণ-সংস্কৃতিকেই একরকম করে চারিয়ে দিয়েছে হিন্দি সিনেমা।
আরও শুনুন:
‘মাকে কাজ করতে দিলে না কেন?’ সুপারস্টার বাবাকে প্রশ্ন করেছিলেন টুইঙ্কল
সাম্প্রতিক সময়ে এই সংস্কৃতির আরও খোলামেলা প্রকাশ দেখা গিয়েছে। কবীর সিং কিংবা অ্যানিম্যাল-এর মতো ছবিগুলি যে উগ্র পৌরুষকে জাহির করেছে, তার অংশ হয়ে এসেছে নারীর প্রতি প্রকট অসম্মান। নারীকে নিজেদের অধিকারে রাখা, তার উপর জোর খাটানোকে ভালোবাসার প্রকাশ বলে দাবি করে বসেছে কবীর সিং। অ্যানিম্যাল একদিকে যেমন খলনায়ককে বৈবাহিক ধর্ষণ করতে দেখিয়েছে, অন্যদিকে নায়কের অবাধ যৌনাচারকেও প্রশ্রয় দিয়েছে। কথা হল, গল্পের প্রয়োজনে যদি বা এমন কিছু দেখাতে হত, সেখানে কোথাও এই বার্তা পৌঁছে দেওয়াও জরুরি যে এই আচরণ আদৌ মানবিক নয়। অথচ ছবিগুলির পরিচালক থেকে কলাকুশলী, কারও কথায় সেই বার্তাটুকু আসেনি। উলটে এই পৌরুষ সংস্কৃতিকেই কার্যত পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন তাঁরা। হিন্দি ছবিতে মেল গেজকে তুষ্ট করার জন্য নারীশরীরের ব্যবহার ছিলই, তার উপর এই ধর্ষণ সংস্কৃতির রমরমা জাঁকিয়ে বসছে সেখানে। আর হিন্দি ছবির বিরাট বাজারের কাছে তা পৌঁছেও যাচ্ছে অতি সহজেই। যে দেশ চুলের ছাঁট থেকে টিশার্টের ছবিতে নায়ককে আঁকড়ে ধরে, সিনেমার অ্যাংরি ইয়ংম্যান বা দাবাং কপ যেখানে যুবসমাজের কাছে রোল মডেল হয়ে ওঠেন, সেখানে সিনেমার মাধ্যমে ধর্ষণ সংস্কৃতির জেগে থাকা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক। ধর্ষণ-সংস্কৃতি নিয়ে দেশে খানিক সচেতনতা বাড়ছে, তবে এই আবহে হিন্দি সিনেমার চোখ খুলবে তো?