যব পেয়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া – তাঁর চোখের দিকে তাকিয়েই যেদিন অন স্ক্রিন গেয়ে উঠেছিলেন মধুবালা, অসংখ্য প্রেমিক হৃদয় সেদিনই যেন পেয়ে গিয়েছিল তাদের আশ্রয়। তিনি দিলীপ কুমার। ভারতীয় সিনেমার ট্র্যাজেডি কিং। রিল থেকে রিয়েল – দিলীপ সাহাবের রোমান্সে বরাবর মিশে থেকেছে ট্র্যাজেডির ছোঁয়া। সে-কথাই শোনাচ্ছেন চৈতালী বক্সী।
পর্দায় তাঁকে দেখেই রোমান্সে হাতেখড়ি হয়েছে কত না যুবকের। তাঁর চোখের জল চোখ ভিজিয়েছে অসংখ্য সিনেপ্রেমীর। তিনি হেসে উঠলেই রোদ উঠেছে কত না যুবকহৃদয়ে। দিলীপ কুমার মানেই সিনেমার পর্দায় লেখা অমর প্রেমকথা। দিলীপ কুমার মানেই ট্র্যাজেডির বিষণ্ণতায় নেমে আসা আচ্ছন্নতা। আর দিলীপকুমার মানেই অভিনয় আর স্টারডমের এমন এক ককটেল, যা কয়েক দশক বুঁদ করে রেখেছে আপামর ভারতবাসীকে। ধর্মেন্দ্র থেকে শাহরুখ খান– তাঁকে দেখেই তো স্বপ্ন দেখার শুরু এঁদেরও। নায়কদের নায়ক তিনি। এক এবং অদ্বিতীয় দিলীপ সাহাব।
রিল লাইফের ট্র্যাজেডি কিং-এর বাস্তব জীবনও ছিল বেশ রঙিন। তবে সেখানেও যেন খানিক ট্র্যাজেডি এসে মিশেছিল। যেন মিলেমিশে গিয়েছিল রিল আর রিয়েল লাইফ।
একসময় সিনে ইন্ডাস্ট্রির অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল দিলীপ সাহাব আর মধুবালার প্রেমকাহিনি।
মধুবালার সঙ্গে দিলীপ সাহাবের দেখা, ১৯৪৪-এ ‘জোয়ার ভাঁটা’ ছবির সেটে। কিন্তু তাঁদের সম্পর্কের সূত্রপাত বছর সাতেক পর, ‘তারানা’ ছবির সময় থেকে। আর রিয়েল লাইফ ঠেলে রিল লাইফে একসঙ্গে জুটি হিসেবে তাঁরা আসেন, ‘সংদিল’ ছবিতে। মন দেওয়া-নেওয়া পর্ব সারা হয়েছিল। কথা ছিল, দ্রুত বিয়েটাও সেরে ফেলবেন। কিন্তু সব কিছু বদলে গেল ১৯৫৬ সালে বি আর চোপড়ার ‘নয়া দউর’ ছবির সময়। সেই ছবিতে জুটি হিসেবে কাজ করার কথা ছিল দিলীপকুমার এবং মধুবালার।
আউটডোর শুটিং-এর সময়ে মধুবালার বাবা আতাউল্লা খান বেঁকে বসেন।
মধুবালাকে কিছুতেই তিনি বাইরে যেতে দেবেন না। এদিকে তাঁর জেদে শুটিং তো প্রায় বিশ বাঁও জলে। ঠিক হল, মধুবালাকে বাদ দিয়ে বৈজয়ন্তীমালাকে নেওয়া হবে ছবিতে। জল গড়াল আদালত পর্যন্ত।
কোর্টে সাক্ষী দিতে আসেন দিলীপকুমার। তিনি জনসমক্ষে তাঁদের সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। জানান, মধুবালাকে তিনি খুবই ভালবাসেন। কিন্তু মধুবালার বাবা এই সম্পর্ককে ভাল চোখে দেখেন না। তাই তিনি মধুবালাকে আউটডোরে যেতে অনুমতি দেননি।
এই নিয়ে তিক্ততা একসময় চরমে ওঠে। দিলীপ সাহাব তাঁর বাবাকে অপমান করেছেন- এই কারণে, মধুবালা সম্পর্কে দাঁড়ি টেনে দেন তখনই । তিনি জানান, দিলীপ সাহাব কোর্টে সাক্ষী দিয়ে তাঁর বাবাকে চূড়ান্ত অপমান করেছেন। তাই তাঁর বাবার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু দিলীপ সাহাব ক্ষমা চাইতে নারাজ। মধুবালা জানান, জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়ার দরকার নেই। অন্তত একান্ত পরিসরে দিলীপ কুমার ক্ষমা চান। কিন্তু তাতেও নারাজ নায়ক। এর পরে এই সম্পর্ক আর জোড়া লাগেনি। সিনেমার মতো বাস্তবেও অবধারিত নেমে এল ট্র্যাজেডি।
জেদের কারণেই মধুবালা সম্পর্ক ভেঙেছিলেন। কিন্তু কিছুতেই দিলীপ সাহাবকে ভুলতে পারেননি।
আরও শুনুন : টলিপাড়ায় কেন এত সম্পর্কের ভাঙন? দায়ী কি শুধুই তৃতীয় ব্যক্তি?
অনেক পরে, অসুস্থ মধুবালা যখন মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভরতি, তখন তিনি একবার দেখতে চাইলেন দিলীপ সাহাবকে। খবর পেয়ে তিনি তুরন্ত ছুটে এলেন হাসপাতালে। প্রিয় মধুর মাথার কাছে বসলেন। তাঁকে দেখে অসুস্থ মধুবালা যেন খানিক ভরসা পেলেন। প্রিয় মানুষের দেখা পেয়ে, তড়িঘড়ি মধুবালা বিছানায় উঠে বসতে চাইলেন। কিন্তু অসুস্থ শরীরে পেরে উঠলেন না। দিলীপ সাহাবের হাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। দিলীপ সাহাব তাঁকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বললেন, ‘তুমি সেরে উঠবে মধু। এত মন খারাপ কোরো না। আমরা আবার একসঙ্গে কাজ করব।’ মধুবালা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার আমাকে এখনও মনে পড়ে!’ দিলীপ কুমার খুব নরম স্বরে বললেন, ‘যদি তোমায় ভুলেই যেতাম, তাহলে কি ডাকলেই চলে আসতাম!’
সেদিন ওই হাসপাতালের ঘরেই যেন লেখা হয়েছিল এই অপূর্ণ প্রেমকাহিনির অপূর্ব ক্লাইম্যাক্স।
এরপর দিলীপ সাহাবের সঙ্গে সায়রা বানুর দেখা প্রেম এবং নিকাহ। এরপরেও প্রেম এসেছে দিলীপ সাহাবের জীবনে। সায়রা বানুর সঙ্গে সম্পর্কেও এসেছে নানা চড়াই-উতরাই। তবে সব পেরিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে থেকে গেলেন সায়রাই।
আরও শুনুন : Sach Kahun Toh : আত্মজীবনীর খোলা পাতাতেও Bold নীনা
মুম্বইয়ের সান্তাক্রুজ কবরস্থানে গান স্যালুটে শেষ বিদায় জানানো হল দিলীপ সাহাবকে। শেষ হল ভারতীয় সিনেমার এক সোনার অধ্যায়। থেকে গেল তাঁর কাজ। থেকে গেল তাঁর জীবনের রঙিন অথচ অপূর্ণ সব প্রেমের গল্প। হয়তো সেসবের দিকে তাকিয়েই ভবিষ্যতের কেউ, দিলীপ কুমারকে স্মরণ করে আবার বলে উঠবে – পেয়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া।