উলটো দিক থেকে হেঁটে আসছেন তাপসি পান্নু। আর পাপারাজ্জিদের ক্যামেরার একেবারে সামনে চলে এসেছেন একজন ডেলিভারি বয়। যথারীতি পাপারাজ্জিরা তাঁকে সরে যেতে বলেন। তাপসিও নিজের মতো হেঁটে তাঁর গাড়ির দিকে চলে যান। আর এর মধ্যে সেই ডেলিভারি বয় কী করলেন?
পর্দায় তাঁরা আসেন। অন্ধকার সিনেমাহলে ফেরি করেন হাজারও স্বপ্ন। আর এপারে বসে দর্শক মনে মনে ভালোবাসার ফুল তুলে দেন স্বপ্নসুন্দরী নায়িকার হাতে। এতদিন যেন এই ছিল দস্তুর। নায়িকাদের এক ঝলক চোখের দেখা দেখার জন্য কত না কসরৎ! দূরের তাঁরা যাঁরা, তাঁদের কি নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়? সচরাচর যায় না। দৈবাৎ যদি সে সুযোগ মেলে, তবে কেউ হাতছাড়া করতে চান না। ব্যতিক্রম এক ডেলিভারি বয়। তাপসি পান্নুকে দেখেও যিনি ভ্রূক্ষেপমাত্র করলেন না। আর করবেনই বা কী করে! সময়ে খাবার পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যাঁর কাঁধে, তাঁর কাছে কি পৃথিবীটা নিশ্চিতই পূর্ণিমার চাঁদ নয়। বরং ঝলসান রুটির বাস্তবতা তিনি বেশ ভালোই জানেন।
গিগ শ্রমিকদের অভাব-অভিযোগ নিয়ে আজকাল নানা আলোচনা। তবে সাম্প্রতিক এই ঘটনা যেন বদলে দিচ্ছে, গিগ ইকোনমি একজন মানুষকে কতখানি বদলে দিতে পারে। ঘটনা বলতে সামান্যই। ইদানীং পাপারাজ্জি কালচারের রমরমা। সেরকমই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, উলটো দিক থেকে হেঁটে আসছেন তাপসি পান্নু। আর পাপারাজ্জিদের ক্যামেরার একেবারে সামনে চলে এসেছেন একজন ডেলিভারি বয়। যথারীতি পাপারাজ্জিরা তাঁকে সরে যেতে বলেন। তাপসিও নিজের মতো হেঁটে তাঁর গাড়ির দিকে চলে যান। আর এর মধ্যে সেই ডেলিভারি বয় কী করলেন? না তারকার বিস্ময় তাঁকে থামিয়ে দেয়নি। মুগ্ধ হয়ে যে তিনি তাপসিকে দেখছেন তাও নয়। তাঁর যা কাজ তাই-ই করছেন। যে ঠিকানা তিনি খুঁজছিলেন, তা খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে যাচ্ছেন। নায়িকাকে দেখ দু-দণ্ড দাঁড়ানো বা তাঁর স্টারডমে বুঁদ হয়ে যাওয়ার লক্ষণমাত্র নেই। অনেকে বলছেন, হতে পারে তাপসি তাঁর পছন্দের নায়িকা নন। তা সত্ত্বেও সিনেমার মানুষকে সামনে দেখলে সাধারণ দর্শকের বিস্ময় কাজ করে। এক্ষেত্রে তাও দেখা যায়নি। বরং ডেলিভারি বয়ের অভিব্যক্তিকে যা ধরা পড়েছে, তা হল, এক ধরনের নিস্পৃহতা। সময়ের মধ্যে তাঁকে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। অতএব নষ্ট করার মতো সময় তাঁর হাতে নেই।
অথচ এই নায়ক-নায়িকাদের ভিডিও ভারচুয়াল মিডিয়ামে লক্ষ লক্ষ মানুষ তা দেখেন। ফলে, নায়িকাদের সম্পর্কে কৌতূহল যে একেবারে নেই তা তো নয়। তাঁদের ঘিরে থাকে যে ইন্দ্রজাল, তাও একেবারে মিলিয়ে যায়নি। সময় বদলেছে, ফলে খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। নয়ের দশকেও নায়ক-নায়িকাদের ঘিরে যে রহস্য রচনা হত, আজ আর তা নেই। সোশ্যাল মিডিয়া এসে যেন পর্দার মানুষ আর দর্শকের মধ্যে দূরত্ব অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও কৌতূহল থেকে গিয়েছে। তবে তার থেকেও যা বড়, তা হল পেটের টান। গিগ শ্রমিকদের যেভাবে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তা উপেক্ষা করার সাধ্য কোথায়! বিনোদনের থেকে অনেক জরুরি রুটিরুজি। আর তা উপার্জনের দৌড় আজ এতটাই খরখরে যে সেখানে যেন মোলায়েম বিনোদনের কোনও জায়গাই নেই। স্বপ্নসুন্দরী নায়িকা সামনে থাকলেও তাই দাঁড়াবার জো নেই। রানারের ভয় ছিল যদি রাত ফুরিয়ে সূর্য উঠে যায়! আর গিগ শ্রমিকের ভয়, যদি খাবার পৌঁছনোর সময় পেরিয়ে যায়! এই ভয়ের কাঁটাই যেন মানুষটাকে বদলে দিয়েছে অন্দর থেকে।
নেটদুনিয়ায় অনেকেই হয়তো বলছেন, তাপসি তাঁর কাজ করেছেন। পাপারাজ্জিরা তাঁদের কাজ করেছেন। আর ডেলিভারি বয় তাঁর নিজের কাজটুকু করেছেন। এ নিয়ে আর বেশি আলোচনার কী আছে! সত্যিই নেই বটে! তবে, সাধারণ ভাবে আমাদের দেশে নায়ক-নায়িকাদের প্রতি দর্শকের যে মোহ কাজ করে, তা আজও অটুট। আর সেখানেই এই ডেলিভারি বয় একেবারে ব্যতিক্রম হয়ে ধরা দিয়েছেন। প্রশ্ন হল, কে তাঁকে এতটা বদলে দিয়েছে! তাঁর পেশাই তো। যে পেশার খাতিরে দু-দণ্ড অবসর নেওয়ার উপায় নেই, এমনকী সামনে নায়িকা থাকলেও দাঁড়াবার জো নেই। সময় অনেক দামি, হাতছাড়া করার উপায় নেই। প্রায় সব পেশাই মানুষকে ভিতর থেকে কিছুটা হলেও বদলে দেয়। ছোট্ট এই ঘটনা তাই যেন বলে দিল, গিগ ইকোনমি কীভাবে বদলে দিতে পারে মানুষের মন। যে কাজ পেশাদারিত্ব বলে প্রশংসা আদায় করছে, আদতে তা যেন বাধ্যবাধকতারই নামান্তর। ভাবনার অবকাশ রয়ে আছে ঠিক সেই জায়গাটিতেই।