নারীনির্যাতনের প্রতিবাদে যখন রাজ্য উত্তাল, নারীর সুরক্ষা চাইছে গোটা দেশ, সেই সময়েই রুপোলি দুনিয়ায় আরেক ছবি। ছোটপর্দার সিরিয়ালে নারীশরীরের প্রদর্শন হয়তো কম, কিন্তু নারীর প্রতি হিংসা সেখানে আদৌ কম নেই। বিশেষ করে গৃহহিংসার ছবি সেখানে বারবার উঠে আসছেই। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
দিনকয়েক আগেই গার্হস্থ্য হিংসা ইস্যুতে চর্চায় উঠে এসেছিল এক বাংলা সিরিয়াল। ‘কার কাছে কই মনের কথা’ সিরিয়ালে দেখানো হয়, সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতেও পিছপা নয় তার স্বামী। এদিকে স্বামীর দুর্ব্যবহার সত্ত্বেও তাকে সে ঘরে যেতে জোর শাশুড়ির। সিরিয়াল হলেও, তাতে গৃহহিংসার এহেন বাড়াবাড়ি দেখে বিরক্তি উগরে দিয়েছিলেন দর্শকেরা।
কিন্তু সত্যি বলতে, এই বিষয়টি ছোটপর্দার দর্শকেরা যে প্রথমবার দেখছেন, এমন নয়। গড়পড়তা দর্শকের কাছে বাংলা বা হিন্দি সিরিয়ালই বেশি পৌঁছয়। আর সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নায়িকার প্রতি কখনও না কখনও নানাভাবে দুর্ব্যবহার নেমে আসে। এমনকি গায়ে হাত তোলার মতো ঘটনাও ঘটে। আর তা ঘটান পরিবারের লোকেরাই। শুধু নায়িকাই নয়, অন্য নারীচরিত্রের প্রতিও অনেকসময় সে আচরণ দেখা যায়। এই যেমন ধরা যাক, সাম্প্রতিক আরও একটি সিরিয়ালের কথা। হিন্দি সিরিয়াল ‘অ্যাডভোকেট অঞ্জলি অবস্তি’-তে দেখানো হয়েছে, হবু স্ত্রীর বাড়িতেই গৃহপরিচারিকা পদ্মাকে ধর্ষণ করেছে এক ধনীর ছেলে। অথচ সব ঘটনা জানাজানি হলে সেই যুবকের শাশুড়ি সপাটে চড় মারেন অসহায় মেয়েটিকেই। বাড়ির সব লোকের সামনে, এক মেয়েকে চড় মারছে অন্য আরেক মেয়ে, বাংলা হিন্দি দু’ধারার সিরিয়ালেই এই দৃশ্য ভীষণরকম চেনা। রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে আমাদের সমাজে নানারকম আলোচনা চলে বটে, কিন্তু প্রত্যেক পরিবারের বসার এবং শোয়ার ঘরে গার্হস্থ্য হিংসার এই ছবি নিয়েও কি কথা হওয়ার প্রয়োজন নেই?
:আরও শুনুন:
ধর্ষণ-সংস্কৃতি নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে, হিন্দি সিনেমার চোখ খুলবে তো?
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বাস্তবের মা যেমন করিয়া কাঁদে, সাহিত্যের মা তেমন করিয়া কাঁদে না। সাহিত্যের জায়গায় সিনেমা বললেও কথাটা আদতে একই থাকে। বাস্তবে যা ঘটে, রুপোলি পর্দা তার ছবি দেখালেও একেবারে একইভাবে দেখাতে পারে না। সুতরাং এ কথা ঠিক যে, সেখানে বাস্তব ঘটনা আরও চড়া সুরে বাঁধা হয়। মানুষ সেইরকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই সেসব দেখতে বসেন। ব্যক্তিগত জীবনকে তার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে না। তবে সিরিয়াল কিন্তু পরিচিত পরিমণ্ডলকেই অনেকখানি তুলে ধরে। আত্মীয় বান্ধবের চেনা গণ্ডিতে যখন দর্শক ঘোরাফেরা করছেন, সেখানেই দেখা যায়, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একাধিক বিবাহ। ৪৯৮-এর আশ্বাসকে উড়িয়ে পরিবারের সকলে মহিলা সদস্যকে যথেচ্ছ নির্যাতন করেন। এ কথাও তো মনে রাখার যে, সিরিয়ালের দর্শকের একটা বড় অংশই মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত মানুষেরা। পর্দায় যা কিছু দেখা যায়, তা তাঁদের জীবনে অনেকখানি প্রভাবও ফেলে বইকি। সেই যে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, থিয়েটারে লোকশিক্ষে হয়, জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রাখলে সে দায় কিন্তু আজকের সিরিয়ালের উপরেও খানিক বর্তায়। সিরিয়ালের প্রভাবে বাঙালি বিয়েতে নাহয় সংগীত চালু হোক, কিন্তু ‘স্ত্রীকে চড় মারা যায়, যে কোনও ভাবে অপমান করাই যায় আর এ সবকিছুকে ভালোবাসা বা অধিকারবোধ বলেও চালানো যায়’- সিরিয়াল যদি এ কথা লাগাতার দেখিয়ে চলে, তবে সামাজিক সঙ্কট আরও ঘনিয়ে উঠতেই পারে। মেয়েদের বিপন্নতা নিয়ে সমাজ অন্তত কথা বলছে, তা কোনও একটি বিপন্নতার ঘটনার প্রেক্ষিতে হলেও। কিন্তু সেই বিপন্নতার ইতিহাসকে মনে রেখে রুপোলি দুনিয়া কি নিজেকে একটুও বদলানোর কথা ভাববে না?