বাচ্চা-বড় সবাই মিলে বসে দেখার জন্যই আপাত ভাবে তৈরি এবং সেভাবেই বিজ্ঞাপিত, সেখানেও বহু বিষয়ের অবতারণা হতে পারে। সেখানে ভায়োলেন্সের মারাত্মক প্রকাশ থাকতে পারে, থাকতে পারে মিসোজিনি বা নারীবিদ্বেষ। এমনকী ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ বা তাঁদের শত্রু হিসাবে দেখানো অর্থাৎ অপরায়ণের সূত্রপাতও থাকতে পারে একটি সিনেমার গল্পে।
সপরিবারে দেখার মতো সিনেমা- পোস্টারে যদি এই কথাটি লেখা থাকে, তাহলে অনেক অভিভাবকই হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। নইলে মনে প্রশ্ন জাগে, এই সিনেমা বাচ্চারা দেখতে পারে তো? আসলে প্রশ্নের আড়ালে যে-প্রশ্ন লুকিয়ে থাকে, তা হল সিনেমায় যৌনদৃশ্য বা ঘনিষ্ঠতার কোনও বিবরণ নেই তো! থাকলেই মাথায় হাত। অতএব ওই সপরিবারে দেখার ছাড়পত্র যদি পরিচালক-প্রযোজকরা দিয়ে দেন, তাহলে খানিক স্বস্তি। তবে আসল প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। যৌনতা নয় বাদ গেল, কিন্তু সেই সব সিনেমায় কি এমন কিছু দেখানো হচ্ছে না, যা একটি বাচ্চার পক্ষে ক্ষতিকর! দেখা যায়, আমাদের সিনেমা দেখার গড় অভ্যাসে যৌনতা বা ঘনিষ্ঠতা নিয়ে যত গেল গেল রব, অন্য কিছু নিয়ে সেরকম নেই। তাহলে কি মূল সমস্যা দূর হচ্ছে? মোটেও না। বরং সপরিবারে দেখার ঘোষণা থাকে যে সব সিনেমাতে, সেখানেও এমন অনেক কিছুই থাকে, যা একটি বাচ্চার মনে বহুরকম ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে।
আরও শুনুন: যৌন হেনস্তায় অভিযুক্ত ডিরেক্টরেরা! শাহরুখ বলেছিলেন, মহিলা পরিচালকের সঙ্গে কাজ করাই ভালো
কোন সিনেমা কোন গোত্রে পড়তে পারে তার নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। সেন্সর বোর্ড সেই সব শর্তাবলি মাথায় রেখেই সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে। তবে, সে তো একেবারেই সিনেমার নিজস্ব বিষয়। প্রাপ্তবয়স্ক এবং পরিণতমনস্ক দর্শকের কথা মাথায় রেখেই তৈরি। তা বাচ্চাদের আদৌ দেখা উচিত কি না, তা অনেক জটিল প্রশ্ন। আর এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেন মূলত অভিভাবকরাই। তাঁরাই ঠিক করে দেন, কোনটি বাচ্চারা দেখবে, আর কোন সিনেমায় তাঁদের দেখা বারণ। সেই অভিভাবকদের প্রশ্নেই আসলে সর্ষের মধ্যে ভূত। যখন একজন অভিভাবক প্রশ্ন করেন যে, এই সিনেমা বাচ্চা দেখতে পারে তো- তিনি প্রধানত হয়তো যৌনতা, চুম্বন কিংবা ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের কথাই মাথায় রাখেন। আর শুধু বাচ্চা কেন, যৌনতা নিয়ে আমাদের সমাজে এখনও এতখানি ছুঁৎমার্গ যে, প্রাপ্তবয়স্করাও তাঁদের থেকে বয়সে বড় ব্যক্তির সঙ্গে এরকম সিনেমা দেখতে লজ্জা বোধ করেন।
এদিকে প্রযুক্তির খোলা দুনিয়ায় বাচ্চারা এখন অনেক কিছুই সহজে হাতে পেয়ে যাচ্ছে। দ্রুত বদলে যাচ্ছে তাঁদের ধ্যান-ধারণার দুনিয়া। সেক্ষেত্রে একটি বাচ্চার মনন গঠনের ক্ষেত্রে সতর্কতা যে জরুরি, তা অস্বীকার করা যায় না। তবে রেখে ঢেকে বা কোনও কিছু চাপা দিয়ে এই ধারণার নির্মাণ হতে পারে না। আবার কোনও কিছুকে নিষিদ্ধ করে দূরে সরিয়ে রাখলে তার প্রতি কৌতূহল বাড়ে বই কমে না। দরকার, পারিবারিক স্তরেই খোলামেলা আলোচনা। সে পথও অবশ্য সহজ নয়। কথোপকথনের রীতি আছে, অনুশীলনও আছে।
তবে, এই একটা দিক বাদ দিলেই কি সাত খুন মাফ? মূল প্রশ্ন সেখানেই। যে সিনেমায় যৌনতা নেই, যা বাচ্চা-বড় সবাই মিলে বসে দেখার জন্যই আপাত ভাবে তৈরি এবং সেভাবেই বিজ্ঞাপিত, সেখানেও বহু বিষয়ের অবতারণা হতে পারে। সেখানে ভায়োলেন্সের মারাত্মক প্রকাশ থাকতে পারে, থাকতে পারে মিসোজিনি বা নারীবিদ্বেষ। এমনকী ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ বা তাঁদের শত্রু হিসাবে দেখানো অর্থাৎ অপরায়ণের সূত্রপাতও থাকতে পারে একটি সিনেমার গল্পে। প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষকে যথোচিত সম্মান দিয়ে না দেখার বিষয়টিও থাকতে পারে। থাকতে পারে এরকম আরও বহু জিনিস, যা একটি বাচ্চার মনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। প্রোপাগান্ডা না হলেও, সিনেমা নিশ্চিতই সমসাময়িক বাস্তবতাকে অবলম্বন করেই তৈরি হবে। তবে, সে সিনেমা আদৌ বাচ্চারা দেখবে কি না, তার সিদ্ধান্ত কে নেবে? সেই দায় অভিভাবকদের উপরেই বর্তায়। অথচ যৌনতাকে না দেখানোর ক্ষেত্রে যেভাবে তাঁরা গুরুত্ব দেন, তা অন্য ক্ষেত্রে সেভাবে দেন না।
আরও শুনুন: নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন দেশজুড়ে, অথচ সিরিয়াল জুড়ে সেই গার্হস্থ্য হিংসা
নাহ, যৌনতা বা ঘনিষ্ঠ দৃশ্য বাচ্চাদের দেখার ক্ষেত্রে সওয়াল করার কথা হচ্ছে না। বরং সিনেমা দেখার বা দেখানোর প্রশ্নে খানিক বদল আনা জরুরি। ‘এই সিনেমা আমার বাচ্চা দেখতে পারে তো?’- এই প্রশ্নের উত্তর যেন শুধু যৌনতাতে আটকে না থাকে। প্রশ্নের পরিধি বাড়লে সিনেমা বাছাইয়ের কাজ সহজ হবে। তাতে অন্তত সিনেমার সূত্রে ভুল ধারণা মগজে নিয়ে বাচ্চারা আর বড় হবে না। সপরিবারে সিনেমা দেখার আগে, আমরা তবে আর একটু সচেতন হব কি? এ প্রশ্ন নিজের কাছে নিজেদেরই।