গণিকা বা যৌনকর্মী মানেই যেন নিষিদ্ধ কোনও বিষয়। তা নিয়ে যেন বেশি কথা বলতে চায় না সমাজ। তাঁদেরকে ওই নিষিদ্ধপল্লীর চৌহদ্দির মধ্যে বেঁধে ফেলতে পারলেই যেন স্বস্তি। এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও ভাঙা যায়নি সেই ট্যাবু। তবু তাঁদের গল্প, তাঁদের কথা বারবার উঠে এসেছে সাহিত্যের পাতায়, সিনেমার পর্দায়। সদ্য মুক্তি পেয়েছে সঞ্জয় লীলা বনশালি পরিচালিত গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি। সেখানেও বলা হয়েছে এক গণিকার গল্প, যার ভয়ে ষাটের দশকে কাঁপত গোটা মুম্বই। স্বভাবতই গাঙ্গুবাই জুড়ে প্রত্যাশা তুঙ্গে। তবে এ-ই প্রথম নয়। এর আগেও বলিউডে জায়গা করে নিয়েছে সমাজের সেই তথাকথিত ‘নিষিদ্ধ’ মানুষদের গল্প। তেমনই কিছু বলিউডি চরিত্রের কথা শুনে নেব আজকে।
উগ্র সাজ, চড়া মেকআপ, স্বচ্ছ পোশাকের মধ্যে দিয়ে উপচে ওঠা শরীরী আবেদন। যৌনকর্মী বললেই যেন সেই ছবিটাই ভেসে ওঠে একঝলক। আসলে এ সবটাই বোধহয় সমাজের বানিয়ে তোলা একটা কাঠামো। যা গণিকা বা যৌনকর্মী শব্দটার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে জোর করে। এর কিছুটা হয়তো সত্যি, কিছুটা বা নয়। কারণ এঁদের নিয়ে কথা বলতে আজও তেমন স্বচ্ছন্দ নয় সমাজ। তাঁদের অধিকার বা জায়গা করে দেওয়ার তো দূরের ব্যাপার। তবু সাহিত্যের প্রয়োজনে, সিনেমার পর্দায় বারবার ধরা পড়েছে তেমনই কিছু যৌনকর্মীর জীবন।
সদ্য বড়পর্দায় মুক্তি পেয়েছে গাঙ্গুবাইয়ের গল্প। সঞ্জয় লীলা বনশালির ছবি ঘিরে এমনিতেই প্রত্যাশা বেশি দর্শকদের। তার উপর ট্রেলার থেকেই চোখ টেনেছিলেন গাঙ্গুবাইয়ের ভূমিকায় আলিয়া। সাদা শাড়ি, কপালে লাল টিপ, অন্যরকম মেজাজ সবটা মিলিয়েই ‘গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাড়ি’ রয়েছে আলোচনার শীর্ষে। এ ছবিতে আলিয়া একজন যৌনকর্মীর ভূমিকায়। এতদিন ধরে যে ভাবে দর্শক যৌনকর্মীদের দেখে অভ্যস্ত, এ ছবিতে আলিয়া যেন তার থেকে আলাদা। শুধু কি গাঙ্গুবাই বলেই, নাকি সেই বানিয়ে তোলা কাঠামো ধীরে ধীরে ভাঙতে শিখছে বলিউডও।
আরও শুনুন: আলিয়ার সঙ্গে মিল, ঠিক যেন গাঙ্গুবাই! সংস্কার ভেঙে যৌনকর্মী মায়ের ছবি সামনে আনলেন ছেলে
তবে গাঙ্গুবাই-ই প্রথম নয়। এর আগেও বড়পর্দায় তেমন বেশ কিছু চরিত্রকে পেয়েছি আমরা। যৌনকর্মীদের জীবন মানেই বোধহয় তার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে জড়িয়ে রয়েছে প্রবঞ্চনা আর লড়াইয়ের গল্প। আর সে গল্পই বারবার ফুটে উঠেছে সিনেমায়। রাজেশ খান্না, শর্মিলা ঠাকুর অভিনীত ‘অমর প্রেম’ সিনেমাটির কথা মনে আছে? বাংলাতেও ‘নিশিপদ্ম’ নামে একটি ছবি হয়েছিল একই গল্পের উপর ভিত্তি করে, যেখানে অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার। সে যাই হোক, সেই সিনেমায় শর্মিলা এককালে নিষিদ্ধপল্লীর বাসিন্দা ছিলেন। আর সে কারণেই তাঁকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে কম গঞ্জনা সহ্য করতে হয়নি রাজেশ খান্নাকে। কিংবা ধরুন, ‘উমরাও জান’ নামে সেই কালজয়ী সিনেমাটির কথা। যেখানে রেখার অভিনয় মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের। পরে এই ছবিটির ফের রিমেক করে বলিউড। সেখানে অভিনয় করেছিলেন ঐশ্বর্যা রাই। উমরাও জানের জীবনযুদ্ধের কথা আরও একবার ফুটে উঠেছিল বড়পর্দায়। সেখানেও কিন্তু সেই উগ্রতার কাঠামো ভেঙেছিলেন পরিচালক। বাইজীর ভূমিকায় অসাধারণ স্নিগ্ধ লেগেছিল ঐশ্বর্যাকে।
সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘রাজকাহিনী; ছবির গল্প নিয়ে বলিউডে তিনি তৈরি করেন ‘বেগম জান’ নামে একটি ছবি। যেখানে ধরা পড়েছিল পঞ্জাবের দেশভাগ আর একটি কোঠাবাড়ির গল্প। দেশভাগের কাঁটাতার গিয়েছিল সেই কোঠাবাড়িটির উপর দিয়ে। যার প্রতিবাদ করেছিলেন সেই বাড়ির বাসিন্দারা। এক দল গণিকা ও তাঁদের নিজের একখণ্ড দেশ নিয়ে লড়াইয়ের সেই গল্পই পর্দায় দেখিয়েছিলেন পরিচালক। ছবিতে বেগম জানের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিদ্যা বালান।
শ্যাম বেনেগল পরিচালিত ‘মান্ডি’ গল্পেও উঠে এসেছিল একটি গণিকাপল্লীর গল্প। একদল যৌনকর্মীর জীবন ও নিষিদ্ধপল্লীর রাজনীতি নিয়ে তৈরি সেই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন শাবানা আজমি, স্মিতা পাতিল, নাসিরুদ্দিন শাহ, অমরীশ পুরির মতো একঝাঁক তারকা।
আরেকটি সিনেমার কথা না বললেই নয়। সেটি হল সুধীর মিশ্র পরিচালিত ‘চামেলি’। যেখানে চামেলির ভূমিকায় নজর কেড়েছিলেন করিনা কাপূর। স্ত্রী-বিয়োগের পরে জীবনবিমুখ রাহুল বোসকে ফের জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য করেছিলেন যৌনকর্মী চামেলি।
আরও শুনুন: স্বামী বিক্রি করে দিয়েছিল নিষিদ্ধপল্লিতে, সেই গাঙ্গুবাইয়ের জীবনই এখন সিনেমায়
এমনই কোনও এক যৌনপল্লী থেকে শুরু করে এককালে মুম্বই শাসন করেছেন গাঙ্গুবাই। হয়ে উঠেছিলেন রীতিমতো এলাকার ত্রাস। তার পাশাপাশি যৌনকর্মীদের অধিকারের দাবিতেও যথেষ্ট সরব ছিলেন গাঙ্গুবাই হরজীবনদাস। মায়ানগরীর সেই যৌনপল্লীটির কাছে আজও গাঙ্গুবাই তাদের মা, ঈশ্বর।
এবার সেই গাঙ্গুবাইয়ের ভূমিকাতেই অভিনয় করছেন আলিয়া। বাকি সব সিনেমার মতোই সঞ্জয় লীলা বনশালীর এই সিনেমাটিও মুখোমুখি হয়েছে বিতর্কের। যাঁর ভূমিকায় আলিয়া অভিনয় করছেন, সেই গাঙ্গুবাই হরজীবনদাসের দত্তক ছেলেমেয়েরা ছবিটি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। গাঙ্গুবাইকে যৌনকর্মী হিসাবে দেখানো নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন তাঁরা। ফলে বলার অপেক্ষা রাখে না, আজও যৌনকর্মীদের পেশা নিয়ে কতখানি রক্ষণশীল এই সমাজ। তবু বলিউডের হাত ধরে সেই ট্যাবু যে ভাঙছে, সেটাই বোধহয় আশার কথা।