ভোটের হাওয়ায় উড়ছিল দেশপ্রেমের আবির। সেই রঙেই পরপর ডুব দিয়েছে বলিউডের একাধিক সিনেমা। কিন্তু ভোটের ফলাফলে যখন সেই উগ্র জাতীয়তাবাদের রাজনীতি খানিক পিছু হটল বলা চলে, তখন কি অতি দেশপ্রেমের কবল থেকে মুক্তি পাবে সিনেমাও?
‘রাস্তায় বসে লাশের আগুনে পুড়িয়ে খাচ্ছে ধর্ম/ রক্তবমির মতন ওগরাচ্ছে দেশপ্রেম।’- দুয়ারে যখন নির্বাচন, তখন সিনেমার দেশপ্রেমের জোয়ার দেখলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এ পঙক্তি মনে হতেই পারে। হ্যাঁ, জন্ম থেকেই প্রতিবাদের ভাষা কিংবা কোনও সামাজিক বার্তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে আসছে সিনেমা। কিন্তু সেই বার্তা যখন এক এবং একমাত্র দেশপ্রেমের কথাই আওড়ে চলে, নানাভাবে, নানা রূপে, তখন সন্দেহ হয় বইকি। মনে পড়ে যায়, ১৯৩৩ সালে নাৎসি ভক্ত সিনেমা পরিচালকদের নিয়ে হিটলারের গড়া সেই কমিটি, যার নাম ছিল ‘রাইখ মিনিস্ট্রি ফর পিপলস এনলাইটেনমেন্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা’। এই কমিটির হাত ধরেই একে একে তৈরি হচ্ছিল ‘ট্রাম্ফ অব দ্য উইল’, ‘জুড সুস’, ‘দ্য ইটারনাল জিউ’-এর মতো ছবি, যেখানে শুধুই হিটলারের জয়গান, আর ইহুদিদের দেশবিরোধী, আতঙ্কের কারণ হিসেবে তুলে ধরা। সিনেমার মধ্যে দিয়ে প্রোপাগান্ডা বুনে দেওয়ার এই ছক শাসকের মজ্জাগত। আসলে দেশপ্রেম যে এক তুমুল আবেগ। যে আবেগে টালমাটাল হলেই ওঁত পেতে আছে উগ্র দেশপ্রেমের খাদ। আসলে ভক্তি যে কখন অন্ধত্বের দিকে পা বাড়ায়, আর সেই চোরাবালি কখন ধ্বংসের দিকে টেনে নেয়, অন্ধ মানুষ তা বুঝতেও পারে না। সেই বিধ্বংসী আবেগকে কাজে লাগিয়েই বক্স অফিসে মুনাফা আদায় করতে চান পরিচালক-প্রযোজক। আর আবেগ ও পুঁজির এই মেলবন্ধনকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলেন রাজনীতির কারবারিরা। সাম্প্রতিক কালে বলিউডের হিটলিস্ট দেখে যে সমীকরণের দিকে বারবার আঙুল তুলেছেন আলোচকেরা।
আরও শুনুন:
ঘৃণা পেরিয়ে ভালবাসা, সিনেমা থেকে রাজনীতিতে কি মন বদলের নতুন হাওয়া?
উনিশের লোকসভার আগে মুক্তি পেয়েছিল ‘দ্য তাসখন্দ ফাইলস’, মোদির বায়োপিক-এর উজ্জ্বল উদাহরণ। সেই সময়ই মুক্তি পায় ‘উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’। তারপর পুলওয়ামা হামলা ঘটতেই তা নিয়ে ছবি করার জন্য লম্বা লাইন পড়ে যায় বলিউডে। সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের হুংকার আর তা নিয়ে তৈরি ছবি, দুই-ই যে ভোট টানার বড় হাতিয়ার, তা বুঝতে দেরি হয়নি শাসকদলের। সুতরাং চব্বিশের প্রেস্টিজ ফাইটের অনেক আগে থেকেই কোমর বাঁধল বিজেপি ও বলিউড। সন্ত্রাসের গায়ে পাকিস্তান আর মুসলিমের তকমা আঁটতে বলিউড বরাবরই ভালোবাসে, বিজেপির ঝোড়ো দেশপ্রেমের ন্যারেটিভে তাতে শান পড়ল আরও। উনিশের আগেকার ‘উরি’ কিংবা চব্বিশের আগেই মুক্তি পাওয়া ‘ফাইটার’ দেখাল পাক-ভারত সংঘাত, আর পালটা দেওয়ার জন্য ইঙ্গিতে বিজেপির জয়গান। শহিদ বিক্রম বাত্রাকে সামনে রাখলেও, ‘শেরশাহ’ ছবিতেও ভারত-পাক যুদ্ধই ছিল নায়ক। আরেকদিকে এমন ছবির ভিড় বাড়ল, যেখানে মুসলিমবিদ্বেষ রয়েছে, অথবা রয়েছে ‘সেকুলার’ বা ‘মার্ক্সিস্ট’-দের প্রতি বিষ, কিংবা কৌশলে কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বিদ্বেষের জমি তৈরি। এ ধারায় সবচেয়ে জরির নাম দুটি ছবির, বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘কাশ্মীর ফাইলস’ এবং সুদীপ্ত সেনের ‘দ্য কেরালা স্টোরি’। দুই ছবিরই তথ্যগত ভুল নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছিলেন বহু পরিচালক। কিন্তু সেই সমালোচনাকে ছাপিয়ে এই দুই ছবিকে করমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এমনকী, সংসদেও এই ছবির ভূয়সী প্রশংসাও হয়। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জুরিবোর্ডের প্রধান তথা ইজরায়েলি চলচ্চিত্র নির্মাতা নাদাভ লাপিদ বিবেকের ছবিকে ‘প্রোপাগান্ডা’ বলার জেরে খোদ ইজরায়েল থেকে অবধি কড়া বার্তা পান। এই তালিকাতেই পরপর আসতে থাকে ‘বস্তার’, ‘জেএনইউ’, ‘৭২ হুর’, ‘আর্টিকল ৩৭০’-এর মতো ছবি। ‘অটল’ কিংবা ‘সাভারকর’-এর মতো বায়োপিক বান্নাওর ধুম পড়ে। ‘সাভারকর’-এর অভিনেতা ও পরিচালক রণদীপ হুডা দাবি করে বসেন, নেতাজি, ভগৎ সিং এবং ক্ষুদিরাম বসুর মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাকি অনুপ্রাণিত করেছিলেন সাভারকর।
নির্বাচনী হাওয়ায় দেশপ্রেমের নামে যে বিশেষ ন্যারেটিভ তৈরি করছিল বিজেপি, তাকেই ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব যত্নে পালন করেছে বলিউড। সে দেশপ্রেমে দেশের চেয়ে দ্বেষ অর্থাৎ হিংসার ভাগই বেশি। সেখানে পরতে পরতে ছড়ানো বিভাজন আর অসহিষ্ণুতা। শাসকের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললেই সে দেশদ্রোহী, এই যুক্তিতে একাকার করে দেওয়া হয়েছে দল আর দেশকে। আর সে দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে বারেবারে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে বিশেষ ধর্মের মানুষকেই। ভোটপ্রচারেও সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণাভাষণ যেভাবে ছিটকে ছিটকে পড়েছে, তা ওই অতি দেশপ্রেমেরই ফসল। আর মানুষের মনে এই বিষ আরও চারিয়ে দিয়েছে প্রোপাগান্ডা সিনেমা। বক্স অফিসে এই সিনেমাগুলির বিপুল সাফল্য তাই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে আতঙ্কিত করেছে। কিন্তু বক্তৃতায়, সোশাল মিডিয়ায় যেভাবে ঘৃণাভাষণের উত্তরে জনতার করতালি জুটে গিয়েছে, তাতে এ কথাও বোঝা যায় যে সিনেমাগুলি নিজেদের উদ্দেশ্য সাধন করেছে অনেকটাই। প্রোপাগান্ডার শিকড় ছড়িয়ে গিয়েছে অনেক দূরে।
আরও শুনুন:
পোশাকি প্রতিবাদ নয়, পোশাকই প্রতিবাদ হয়ে মুখর কান-এ
তবে আশা তো শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়। এত বিদ্বেষের পরেও কিন্তু লোকসভার ফলাফল বলছে, সহাবস্থানে আস্থা রেখেছেন দেশের একটা বড় অংশের মানুষ। গেরুয়া শিবিরের ঘৃণাভাষণের বিরুদ্ধে, বিভাজনের মন্তব্যের বিরুদ্ধে পালটা দেওয়ার চেষ্টাও করেছেন তাঁরা। সেই মিলিত চেষ্টার ফলেই খানিক থমকে যেতে হয়েছে বিজেপির উদ্ধত গতিকে। কেবল বিভাজনের বক্তব্যই যে ভোট টানবে না, স্পষ্ট হয়েছে সে কথাও। সুতরাং, সেই প্রোপাগান্ডার কবল থেকে এবার মেনস্ট্রিম ছবিও খানিক মুক্তি পেতে পারে, এমন আশা বোধহয় জিইয়ে রাখা চলে।