স্বজনপোষণের অভিযোগ তুলে নিন্দুকেরা যতই চেঁচাক না কেন, বলিউডে সকলেই যে উত্তরাধিকার সূত্রে নাম-খ্যাতি পেয়েছেন, তা কিন্তু নয়। বরং বহু অভিনেতার সাফল্যের পিছনেই লুকিয়ে রয়েছে দীর্ঘদিনের পরিশ্রম আর কষ্টের গল্প। আজ শুনে নেব সেই সব তারকাদের কথা, যাদের শুরুটা করতে হয়েছিল একেবারে শূন্য থেকে।
তারকাদের ঝাঁ চকচকে জীবন আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু সেই হয়ে ওঠার পিছনে রয়েছে শুরুর দীর্ঘ পরিশ্রম আর কষ্টের দিনগুলো। রয়েছে প্রত্যাখ্যানও। অথচ সে সব হয়তো জানাই হয়ে ওঠে না দর্শকদের। মাঝেমধ্যেই বলিউডের অন্দরে কান পাতলেই শোনা যায় নেপোটিজম বা স্বজনপোষনের অভিযোগ। তবে বলিউডে এমনও অনেক তারকা আছেন, যাদের সেই অর্থে বলিউডে চেনা দাদা-দিদি বা পরিজনেরা ছিলেন না। নিজের যোগ্যতা আর পরিশ্রমের জোরেই যাঁরা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন শক্ত একটা জায়গা।
বলিউড শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চনের কথাই ধরুন না! অমন আকর্ষণীয় উচ্চতা, দুর্দান্ত ম্যানারিজম থাকা সত্ত্বেও শুরুর দিনগুলো কিন্তু সহজ ছিল না তাঁর। থাকার জায়গা ছিল না। বহু রাত কেটেছে মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভে। চাকরির জন্য ঘুরতে হয়েছে দরজায় দরজায়। দু-দুটো রেডিও স্টেশন থেকে প্রত্যখ্যাতও হন তিনি। অভিনয়ের সুযোগ এল বটে। তবে সেখানেও ছিঁড়ল না ভাগ্যের শিকে। পর পর ১২টা ছবি ফ্লপ। তবে হার মানেননি বিগ বি। গত কয়েক দশক শাসন করেছেন বলিউড, শুধু তা-ই নয়, বলিউডের প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছেন তিনিই। বিগ বি-র পরেই বলিউডে একবাক্যে উচ্চারিত হয় যাঁর নাম তিনি শাহরুখ খান। যে শাহরুখের জন্য হৃদয় হারায় আসমুদ্র হিমাচল, তিনি যখন মুম্বইয়ে এসেছিলেন তিনি ছিলেন এক্কেবারে আম আদমী। রেস্তঁরার ব্যবসা খুলেছিলেন দিল্লিতে। অচিরেই ডুবে গেল সেই ব্যবসা। পেট চালাতে বিভিন্ন কনসার্টে উপস্থাপকের কাজ করতেন। অভিনয়ের স্বপ্ন বুকে নিয়ে মুম্বইয়ে এসে ঘুরে মরেছেন অসংখ্য পরিচালকের দরজায়। কিন্তু সেসময় তাঁকে নিতে রাজি ছিলেন না কেউই। হাল ছাড়েননি শাহরুখ। ছাড়েননি স্বপ্নকেও। আর সেই ক্ষমতার জন্যই বোধহয় তিনি কিং খান।
আরও শুনুন: ‘সঞ্জীব কুমার নন, আমিই যোগ্য’, গুলজারকে জানিয়েছিলেন স্কুলপড়ুয়া নাসিরুদ্দিন শাহ
বলিউডের ছক ভাঙা অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম মনোজ বাজপেয়ী। বিহারের দরিদ্র কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসে বলিউডের নামী অভিনেতা। সহজ ছিল না পথটা। এমন দিনও গিয়েছে, যখন চাল কেনারও পয়সা ছিল না কাছে। তথাকথিত নায়কোচিত চেহারা কোনওদিনই ছিল না মনোজের। ফলে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন বহু জায়গা থেকেই। কতবার আত্মহত্যার কথাও ভেবেছেন। তার পরেও লড়াই থামাননি। বিগ-বির ভক্ত মনোজ নাকি মাত্র ন-বছর বয়স থেকেই জানতেন, অভিনয়ই তাঁর ভবিতব্য। সেই আশ্চর্য মনোবলই বোধহয় তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল সাফল্যের শীর্ষে।
দীর্ঘ লড়াই লড়তে হয়েছে অভিনেতা পঙ্কজ ত্রিপাঠীকেও। বিহার থেকে মুম্বইয়ে এসে কোনও মতে একটা এক কামরার ঘরে থাকা। কাজের জন্য দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত হাতে কাজ ছিল না কোনও। সেই সময়ের সমস্ত খরচ, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা থেকে শুরু করে সবটাই, একা হাতে টেনেছেন পঙ্কজের স্ত্রী। বরাবরই মনোজ বাজপেয়ীর ভক্ত ছিলেন পঙ্কজ। অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে তাঁর লড়াই। সেখান থেকে শুরু করে আজ বলিউডের অন্যতম গুনী অভিনেতা পঙ্কজ।
অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির লড়াইয়ের গল্পটা বোধহয় অনেকেরই জানা। ‘কাহানি’ সিনেমা দিয়ে খ্যাতি পেলেও তার আগে যে কতশত ছবিতে কত রকম ভূমিকায় অভিনয় করে গিয়েছেন নওয়াজ, তার ইয়ত্তা নেই। ওষুধের দোকানে কাজ থেকে শুরু করে পাহারাদার- পেট চালাতে করেছেন অজস্র চাকরি। তার সঙ্গেই চলত জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে অভিনয়ের চেষ্টা। আর সেই যুদ্ধই তাঁকে সামান্য ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট থেকে বানিয়ে তুলেছিল বলিউডের অন্যতম শক্তিশালী অভিনেতা।
পর্দার প্রায় সমস্ত চরিত্রের সঙ্গেই একই রকম সুবিচার করতে অনেক অভিনেতাই পারেন না। কিন্তু সেই কাজটাই হাসতে হাসতে করে ফেলেন বোমান ইরানি। এই দক্ষ থিয়েটার অভিনেতাকেও কিন্তু বলিউডে সুযোগ পেতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। এক সময় মুম্বইয়ের একটি নামী হোটেলে বেয়ারার কাজ করতেন। তার সঙ্গেই চলত চুটিয়ে থিয়েটার। আর তার পর সেই সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে পা রাখেন বলিউডে।
এমনিতেই যথেষ্ট পরিশ্রমী অভিনেতা হিসেবে বলিউডে সুখ্যাতি রয়েছে অক্ষয় কুমারের। তা পর্দায় পা রাখার আগেও কম পরিশ্রম করতে হয়নি তাঁকে। এক সময় শেফ ও বেয়ারা হিসেবে কাজ করেছেন হোটেলে। কেরিয়ার শুরু হয়েছিল স্টান্টম্যান হিসেবে। মজার কথা, এখনও নিজের ছবিতে সমস্ত স্টান্ট নিজেই করতে পছন্দ করেন তিনি। সে জন্য অনেকেই নাকি তাঁকে ভারতীয় জ্যাকি চ্যান বলে থাকেন।
আরও শুনুন: কেউ ভয় পান টোমাটোতে তো কেউ সিলিং ফ্যানে, তারকাদের অবাক করা ফোবিয়া
বলিউডের কিংবদন্তি যাঁরা, তাঁদের অনেককেও সামলাতে হয়েছে এমনই ঝড়ঝাপটা। অনেকেই হয়তো জানেন না, অভিনয়ের দুনিয়ায় পা দেওয়ার আগে রাস্তার ধারে ফল বিক্রি করতেন দিলীপ কুমার। সেখান থেকে আর্মিক্লাবে স্যান্ডউইচয়ের দোকান। সেসব সামলেই শুরু অভিনয়। এমন কি শুটিং সেরে বাড়ি ফেরার জন্য ন্যূনতম টাকাটুকুও থাকত না সেসময় পকেটে। সেখান থেকেই একদিন ভারতীয় সিনেমার কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন দিলীপকুমার। অভিনয়ে পা দেওয়ার আগে দীর্ঘদিন কেরানি হিসেবে কাজ করেছেন দেব আনন্দও। সামলেছেন মিলিটারি সেন্সর অফিসারের দায়িত্বও।
কিংবা ধর্মেন্দ্রর কথাই ধরুন না? তাঁকে বলিউডের প্রথম ম্যাসকুলিন নায়ক বললে বোধহয় ভুল হবে না। তবে প্রথম জীবনে নাকি তাঁকেও কলের মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। কত রাত যে খালি পেটেই ঘুমোতে হয়েছে তার হিসেব নেই। সেখান থেকেই হয়ে উঠেছিলেন বলিউডের অ্যাকশন কিং।
বলিউডের ক্ষেত্রে ‘সুপারম্যান’-এর তকমাটা ছিনিয়ে বোধহয় নিতে পারেন একজনই। আর তিনি রজনীকান্ত। মূলত দক্ষিণী ছবির নায়ক হয়েও তিনি শাসন করেছেন বলিউড। তবে তাঁর শুরুটাও কিন্তু হয়েছিল নেহাত ‘কমন ম্যান’ হিসেবেই। জীবন নির্বাহ করতে ছুতোর থেকে শুরু করে বাস কনডাক্টর এমনকি কুলির কাজও করেছেন।
বলিউডে যাঁর হাত ধরে শুরু হয়েছিল ডিস্কোর ধারা। সেই সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তী হয়ে ওঠার পিছনে যে কতশত অভুক্ত, নির্ঘুম রাত লুকিয়ে রয়েছে, চাপা রয়েছে কত অর্থাভাব আর কষ্ট, তা বোধহয় অনেক মিঠুনভক্তরাই জানেন না। মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে মুম্বইয়ে এসে পড়েছিলেন সোনু সুদ। সেখান থেকে লড়াই করে আজ তিনি শুধু বিখ্যাত অভিনেতাই নন, গরিবের মসিহা-ও বটে। লকডাউনে বহু মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন সোনু। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁদের দিকে।
বলিউড তারকাদের এসব লড়াইয়ের গল্প শুনলে বোধহয় বারবার সেই প্রবাদটিই মনে পড়ে যায়। কষ্ট না করলে কেষ্ট কি অত সহজে মেলে নাকি! বলিউডের তাবড় এসব অভিনেতার সাফল্যের পিছনে রয়েছে তেমনই হাজারটা কষ্টের উপাখ্যান।