বাইজির নাচ-গানের সময় প্যালা দেওয়া, অর্থাৎ রুমালে বেঁধে টাকা ছোড়া ছিল বাবুদের দস্তুর। উনিশ শতকের ধনী বাঙালি মহলেও সে চল ছিল ভালোমতোই। টাকার ঔদ্ধত্যে সেখানে শিল্পকে কেনা গিয়েছে হয়তো, কিন্তু শিল্পকে সম্মান করা যায়নি আদৌ।
গান গাওয়ার মাঝখানে উড়ে এসেছিল টাকা। শ্রোতা মনে করেছিলেন, গান ভালো লাগছে বোঝানোর এই হল উপায়। কিন্তু শিল্পী তেমনটা মনে করেননি। গান থামিয়ে দিয়ে তিনি সবিনয়ে ওই শ্রোতাকে বলেন, টাকা দান করতে চাইলে তিনি কোনও সমাজসেবামূলক কাজে সে টাকা দিতে পারেন। আর আয়ুষ্মান খুরানার এই উত্তরেই কুর্নিশ জানাচ্ছে গোটা দুনিয়া। নিজের ব্যান্ড ‘আয়ুষ্মান ভব’-র সঙ্গে মার্কিন সফরে গিয়েছেন তারকা। সেখানেই, নিউ ইয়র্ক শহরের এক কনসার্টে এহেন ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। গান শুনে মঞ্চে ডলার বৃষ্টি করেন এক শ্রোতা। যে আচরণকে রুচিহীন বলেই মনে করছেন সংগীতপ্রেমীরাও। শিল্পী অবশ্য প্রকাশ্যে তেমন কিছুই বলেননি। তবে, টাকার ঔদ্ধত্যে যে শিল্পের কদর হয় না, সে কথাই এই পুঁজির বিশ্বকে বুঝিয়ে দিলেন আয়ুষ্মান খুরানা।
‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে উৎপল দত্ত হাজির করেছিলেন এক অশিক্ষিত বেনে মুৎসুদ্দিকে। সবকিছু কেনাবেচা করাই তার পেশা, লেনদেনেই তার জগৎ আটকে। তাই সে মধুসূদন দত্ত কি বঙ্কিমচন্দ্রকে মাইনে করে রাখার কথা বলতে পারে। সে কথা শুনে কেউ চমকে উঠলেও পরোয়া নেই তার। কেন-না সে মনে করে, ‘দুহাতের দশ আঙুলে দশটা আংটি, একটা দিয়ে এইসব সাহিত্য-ফাহিত্য কিনে নিতে পারি।’ সত্যি বলতে, সবকিছুকেই পণ্য ভাবার এহেন মানসিকতা কি আমরা বাস্তবেও দেখিনি, বা দেখি না? পুঁজির দুনিয়া আমাদের প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দেয়, টাকার বিনিময়ে সবকিছুই কিনে নেওয়া চলে। সূক্ষ্ম অনুভূতি আর সংবেদনেই যার হদিশ মেলে বলে জানত মানুষ, টাকার ঔদ্ধত্য তাকেও হাসিল করতে চায়। সেই ঔদ্ধত্যের কাছে সাধনার দাম নেই, ভালোবাসার স্বীকৃতি নেই, সে কেবল দখলদারি বোঝে। কিন্তু শিল্প, যা দীর্ঘ সাধনার ধন, তার কদর না করে কি তাকে দখল করা যায়? একসময়ের বাইজি-সংস্কৃতি তেমনটাই ছিল অনেকখানি। কোনও কোনও ধনী যে শিল্পরসিক হতেন না তা নয়। তবে অনেকের কাছেই শিল্প ছিল টাকা দেখানোর জায়গা। অন্য ধনীদের সঙ্গে রেষারেষি করে শিল্পীকে বেশি দাম দিয়ে কিনে নেওয়ার চেষ্টা চলত। সেকালের বাইজিরা নাচে-গানে অতুলনীয়া ছিলেন। কিন্তু সেই দক্ষতার কদর করত কজন? ‘ভুলভুলাইয়া’ ছবির কথাই মনে করুন, যেখানে নর্তকীকে নিজের দখলে না রাখতে পেরেই খেপে ওঠেন রাজা। বাইজির নাচ-গানের সময় প্যালা দেওয়া, অর্থাৎ রুমালে বেঁধে টাকা ছোড়া ছিল বাবুদের দস্তুর। উনিশ শতকের ধনী বাঙালি মহলেও সে চল ছিল ভালোমতোই। টাকার ঔদ্ধত্যে সেখানে শিল্পকে কেনা গিয়েছে হয়তো, কিন্তু শিল্পকে সম্মান করা যায়নি আদৌ।
ইতিহাস সেই অসম্মানের সাক্ষী বটে, কিন্তু ইতিহাসও আমাদের সম্মানের পাঠ দিতে পারেনি। বরং পুঁজি আর ভোগবাদের দুনিয়ায় আমরা সবকিছু হাতের মুঠোয় আনার কথাই ভেবেছি। তার যোগ্য হয়ে উঠতে চাইনি, যাতে সে নিজে থেকে এসে হাত ধরে। সে মানুষ হোক কিংবা শিল্প। সবকিছুই আমাদের কাছে স্রেফ পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাকে চাইলেই দখল করা চলে। কিন্তু সেই দখলদারি দিয়ে যে অনুভবকে হাসিল করা চলে না, সে কথাই এবার বুঝিয়ে দিলেন আয়ুষ্মান খুরানা।