ঘোর লাগা বাঙালিয়ানায় সুকুমার-তৃপ্তিতে পুজো কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বাঙালি দেখল, তার নজরুল গিয়েছে চুরি। তা-ও যার তার হাতে নয়, এ দেশের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পীর তত্ত্বাবধানেই। এ আর রহমান কি সত্যিই কাজীসাহেবকে অনুধাবন করে এই গান তৈরি করেছেন? নাকি নেহাতই না বুঝে তাড়াহুড়োর রহমানিয়া সৃষ্টি সামনে এসেছে? বাঙালির বিক্ষুব্ধ মনে অজস্র প্রশ্নের ঢেউ, খতিয়ে দেখলেন রাজর্ষি গুপ্ত।
এ. আর. রহমানের সুরে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ ইউটিউবে মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই বিতর্ক তুঙ্গে। একবার শোনার পর বার বার পুরোনো রেকর্ডিংগুলো শুনে শুনে কান ধুতে হচ্ছে বাঙালি শ্রোতাদের। তাঁদের প্রশ্ন অনেক, ধন্দ বহু।
আরও শুনুন: ধর্ম বদল হয়নি পাত্রীর, ১০০ বছর আগে বিয়েতেও ‘বিদ্রোহী’ ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম
রহমান কি গানের কথা না বুঝে সুর দিয়েছেন? গানের ছন্দ, মূল সুর, পটভূমি এ সব কিছুই কি তিনি বিবেচনা করেননি সুর দেওয়ার সময়? এর উত্তর এক কথায় হয়— ‘না।’ রহমানের কম্পোজিশনটিতে তাড়াহুড়োর সুর স্পষ্ট। শুরুর দিকে দু-একটি ইন্সট্রুমেন্ট বাদ দিলে যন্ত্রায়োজনে গোটা গানের পিছনেই লুপ মিউজিক বেজে চলেছে। এই তাড়াহুড়ো ইদানীংকালের বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির স্বভাবজাত। এই গানটির বরাত পাওয়া থেকে প্রযোজনা পর্যন্ত ঠিক কতদিন সময় রহমান পেয়েছেন জানতে ইচ্ছে করে। নিট ফল— গানের পিছনের গল্প জানা বা কম্পোজিশন নিয়ে গবেষণা করার মতো সময়টুকুও রহমান ও তাঁর টিম দিতে পারেননি।
কিন্তু কাজটা যেখানে কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহকপাট’-এর মতো গান নিয়ে, সেখানে এই ছেঁদো যুক্তি খাটে না। এটা নিছক ‘বাঙালি কবির’ লেখা আর সুরারোপ করা গান বলে বাঙালির আবেগের প্রশ্ন নয়। এর সঙ্গে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ঝরা অখণ্ড ভারতের রক্ত, ঘাম আর চোখের আগুন জড়িয়ে রয়েছে। বাঙালির সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে। আর সাহিত্য-সঙ্গীতের নন্দনতত্ত্ব তো জড়িয়ে আছেই। এ গান বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশাত্মবোধক গান। কথা আর সুরের বাঁধন দিয়ে এ গান বীররসের চূড়া স্পর্শ করেছে। এর প্রতি পদে ‘কারার লৌহকপাট’, ‘রক্তজমাট পাষাণ বেদী’-কে ‘লোপাট করা’, ‘উপড়ে ফেলা’-র ডাক, ‘ভীম কারার’ ‘ভিত্তি নাড়িয়ে’ দেওয়ার আহ্বান। নজরুল যেন প্রচণ্ড উল্লাসে গর্জন করে লাফিয়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন সরগমের উঁচুর শুদ্ধ স্বরগুলিতে— পা, নি, র্সা, র্গা— আবার নেমে আসছেন খাদে— পা, মা, গা, রে, সা। আগুনের গোলার মতো কথার সঙ্গে সুর আর ছন্দের এই উত্থান-পতনই রক্তকে নাচিয়ে তোলে। ১৯৪৯-এ ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন’ ছবিতে এ গান প্রথম রেকর্ড করেন নজরুলের স্নেহধন্য গিরীন চক্রবর্তী। রহমান কি শুনে দেখেছেন কথা-সুরের আগুনে মাতলামি সেই গানে কীরকম রক্তে ছড়িয়ে পড়ে? তাঁর কম্পোজিশনে কথা-সুর-ছন্দের বুননের এই টেকনিকাল জায়গাটাই নেই। তিনিও শুদ্ধ স্বরই লাগিয়েছেন, কিন্তু অনেক পেলব করে। তাঁর সুর প্রেমের গানে মানায়, রক্তে আগুন ধরায় না।
আরও শুনুন: দুর্ভাগা সেই দেশ… সম্প্রীতির প্রয়োজনে শিল্পীর বন্ধুতাও যেখানে মাপা হয় ধর্মের পরিচয়ে
‘কারার ঐ লৌহকপাট’-এ বাংলার মাটির মাতাল করা গন্ধ রহমানের সুরে কোথায়? এ গানের কথা-সুরের যুগলবন্দির চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে একটি শব্দবন্ধে— ‘গাজনের বাজনা বাজা’। বছর শেষের লোকায়ত উৎসব গাজন শিব আর তাঁর অনুচরদের সাহস, বীরত্ব, এমনকী বীভৎসতারও উদযাপনের উৎসব। গোটা গানের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ছবিগুলি দেখুন। ‘ওরে ও তরুণ ঈশান, বাজা তোর প্রলয়বিষাণ’, ‘ওরে ও পাগলা ভোলা, দে রে দে প্রলয় দোলা’— রুদ্ররূপী শিবকে তাণ্ডব নাচতে আহ্বান করছেন নজরুল, যাতে ‘কালবোশেখি’ ঝড়ে সব প্রাচীন ক্লেদ, সব অত্যাচারের দম্ভ ধ্বংস হয়ে নতুনের সৃষ্টি হয়। এ গানের সুরও তাই গাজনের ঢাকের বোলে মিলে যায়, শ্রোতাদের মনেও তাণ্ডব নাচের ঢেউ লাগে। রহমানের টিমের বোধ হয় এত তলিয়ে ভাবার সময় ছিল না। তাঁর কম্পোজিশনে কথা আর সুরের মাঝে ছন্দের কোনও সেতুই নেই, সুরের টান দিয়ে ছন্দের গোঁজামিল স্পষ্ট ধরা পড়ে। আগেও তিনি ‘বন্দে মাতরম’ কিংবা ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ নিয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু এতটা সমালোচিত হননি বাঙালি শ্রোতাদের তরফে, কারণ তাঁর নতুন সুরারোপে সেগুলির স্পিরিট পালটে যায়নি।
কাজী নজরুল ইসলামের মতো একজন কবি-সুরকারের কাজ নিয়ে ছেলেখেলা করবেন এ. আর. রহমানের মতো একজন বিশ্ববন্দিত সুরকার, এ কথা ভাবতেও কষ্ট হয়। কাজীসাহেবের একটি গান শুধু নয়, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামও আজ মান খুইয়ে আজ স্রেফ বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির ‘কন্টেন্টে’ পরিণত হল। রহমান সুরসাধনার মার্গে উঁচুদরের সাধক হয়েও লৌহকপাট ভাঙার গানে এমন পেলব সুরের শিকল পরালেন কেন? ‘লৌহকপাট’-কে তিনি বিজ্ঞাপনী জিঙ্গল বানিয়ে ফেললেন। তাঁর কম্পোজিশন হয়তো অনেক শ্রোতার শরীরকে দুলিয়ে দেবে, কিন্তু তাদের কোনও ‘তালা ভাঙতে’ উদ্বুদ্ধ করবে না; তাদের এমন করে জাগাবে না, যাতে, তারা হুঙ্কার দিয়ে বলতে পারে— ‘কে দেয় সাজা, মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?’ তাহলে কাজীসাহেবের গান কি সকল ঐতিহ্য নিয়ে আদৌ বজায় থাকল রহমানি ছোঁয়ায়? বাংলা ও বাঙালির অন্তরমহলে সেই প্রশ্নই অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু উত্তর মেলে না।