অনুরাগের উপর যত রাগ! বাংলা সিনেমা নিয়ে তাঁর মন্তব্যের জেরে বাঙালির ক্ষোভের ঢেউ উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, অথচ সেই সোশ্যাল মিডিয়াকেই প্রত্যাখ্যানের বার্তা দিয়েছিলেন খোদ অনুরাগ কাশ্যপ। সে-মন্তব্যটি তেমন ক্লিকযোগ্য নয় বলেই বোধহয় তেমন আলোচিত হচ্ছে না। অথচ অনুরাগের বিরুদ্ধে বাঙালির সাম্প্রতিক সোশ্যাল মিডিয়া অভিযানে সেই কথাটাই যেন সবথেকে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
বহু কথার অপ্রাসঙ্গিকতা পেরিয়ে সার কথাটির সন্ধান করলেন প্রিয়ক মিত্র।
অনুরাগ কাশ্যপ ঠিকই জানতেন, বাংলা সিনেমা নিয়ে যাই-ই বলুন, তাই নিয়ে ধর্মযুদ্ধ বাঙালি করবেই! সেই যুদ্ধক্ষেত্রটা সম্পর্কেও ওঁর সম্যক ধারণা ছিল। জানতেন, সারা বছর যে ফেসবুকে গলা চিরে বাংলা সিনেমার গুষ্টি উদ্ধার করে একরাশ প্রতিভাধর কুলমার্তণ্ড, সেই ফেসবুকেই, সেইসব সংস্কৃতি সংস্কারকরা ঝড় তুলবেন! বলবেন, অনুরাগ এখন নিজে কী সিনেমা বানান? অর্থাৎ একুশ শতকে বলিউডে একটা ‘নো স্মোকিং’ বা ‘আগলি’ যে লোকটা বানিয়েছে, যে একটা ‘পাঁচ’ বা ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’-র জন্য নিষিদ্ধ হয়ে বসে থাকে দীর্ঘদিন, যে একটা ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’-কে ভারতীয় সিনেমায় উল্লেখযোগ্য করে তুলতে পারে অন্তত এক শতাব্দীর জন্য, সে বিগত কয়েক বছর তেমন ছবি বানাতে পারেনি, এই অভিযোগের ধুয়া তুলে তাঁকে কাঠগড়ায় তোলা হবে।
কোনও পরিচালকের ফিল্মোগ্রাফিতে পতন থাকবে না? কার নেই? কোন মহান পরিচালকের নেই? তাই বলে সে বাংলা সিনেমা নিয়ে তার মতামত জানাতে পারবে না? বাঙালি চিরকাল ভেবে বসে আছে, তার যাবতীয় সাংস্কৃতিক মিনার বিশ্বমানের। সাহিত্য, চলচ্চিত্র থেকে থিয়েটার। ছিল, আছে এবং থাকবে। অনুরাগ স্পষ্টত বলেছেন, ‘ছিল’, আছে এবং থাকবে না বলেই তাঁর মস্ত অপরাধ হয়েছে।
আমরা বাঙালি, আমরা আমাদের সংস্কৃতির আদ্যশ্রাদ্ধ করব ফেসবুক পোস্টে হাততালি কুড়োতে, আর অনুরাগ এটা কোনও পোস্টে নয়, আলোচনাসভায় বলছেন বলে সেই আমরাই আগুন জ্বালিয়ে দেব। কেউ জাতীয়তাবাদী বুকনি ঝাড়বে, কেউ বলবে, বলিউডই ফালতু, কেউ বলবে, এত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই (এই জ্যাঠামোটাও ফেসবুকেই ঘটছে কিন্তু); কেউ কেউ বলবে, বেশ করেছেন, তাদের সঙ্গে তর্ক জুড়বে অন্য দল।
-: আরও শুনুন :-
‘কবিতা তো আর স্ন্যাক্স নয়!’ মৃদুভাষে সেদিন বলে উঠেছিলেন গুলজার
ফেসবুক অতএব বাঙালির স্বর্গ, নরক, পারগেটরি, হাই কমান্ড, পলিটব্যুরো, মস্কো, পণ্ডিচেরি- সবকিছুই। ফেসবুকের লোকনাথ ও ফেসবুকের সায়েন্টিস্টরা যা যা বলবেন, সেসবই খবর। বাইরের দুনিয়ায় যা ঘটছে, তা ফেসবুকের টোলে, চণ্ডীমণ্ডপে, সালিশি সভায় বা সংসদে আলোচনা না হয়ে পাশ হবে না। এখানেই অনুরাগের অন্য মন্তব্যটি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, যে মন্তব্যটি তেমন ক্লিকযোগ্য নয় বলে, বা শিরোনামের চটক বহন করে না বলে খুব একটা আলোচিত হচ্ছে না। কী বলেছেন অনুরাগ? বলেছেন, স্বদেশির সময় কী হত? যাবতীয় যা বিদেশি দ্রব্য, সেসব জ্বালিয়ে দেওয়া হত তো? তাহলে শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে শাসকের চালানো সোশ্যাল মিডিয়া বর্জন করুন। তরুণ প্রজন্মের সময় এসেছে মোবাইল, আইপ্যাডগুলো জ্বালিয়ে দেওয়ার। তবে হয়তো একটা আন্দোলন হলেও হতে পারে।
অনুরাগের এই মন্তব্য সঠিক কি সঠিক নয়, তা নিয়ে আলোচনার পরিসর আছে। বিজ্ঞানের আশীর্বাদ ও অভিশাপ নিয়ে রচনা লিখেই তো বড় হলাম আমরা। সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে তেমন রচনার অভাব নেই। ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে, টুইটারে (যদিও বেশি লোক এখানে ভিড় করে নেই) বা ইনস্টাগ্রামে-গঞ্জে এখন সমান্তরাল একটা পৃথিবী তৈরি হয়েছে। অতএব নীতিবাগীশ গুরুজন না সেজে প্রযুক্তির এইসব গুণাগুণ তো মেনে নেওয়াই ভাল! অনুরাগ নিজেও তো ফেসবুক করেন, হুমকি ইত্যাদি পাওয়ার আগে তো জমিয়ে টুইটারও করতেন। তাহলে?
-: আরও শুনুন :-
ধন্দে পড়েই দ্বন্দ্ব অহর্নিশ! মান্যতা, দীনতা, বন্ধুতা নিয়েই যত গোলমাল?
এই প্রতিযুক্তির উত্তর একটাই, অনুরাগের এই মন্তব্য সরলরৈখিক নয়। ফেসবুকে আমরা যা বলি, তা স্পষ্ট করে বলতে হয়, তার মধ্যে ধূসরতা রাখা যায় না। মিম থেকে রসিকতার হাত ধরেই নতুন প্রবণতার জন্ম হয় রোজ। নিত্যনতুন ট্রেন্ড দিয়ে ঢাকা হয় পাঁচ মিনিট আগের ট্রেন্ডকে। চমস্কি থেকে জিজেক থেকে বিবেকানন্দ থেকে অনুকূল ঠাকুর, সকলের কোটেশন চলতে পারে, পরীক্ষার খাতায় নম্বর বাড়াতে যেগুলো কাজে লাগে আর কী, কিন্তু গোটা তত্ত্ব কারও পড়ার সময় নেই এখানে। সেই নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর ছড়ার লাইন, ‘ওই ফুল ফোটে বনে, যাই মধু আহরণে, দাঁড়াবার সময় তো নাই’, চট করে মনে পড়ে যায়। কারও সময় নেই, থাকার কথাও নয়। কোনও মন্তব্যের আগে-পরে দরকার নেই। ফেসবুকের অ্যানালিটিক্সও এখন চায়, কথা কম ছবি বেশি। ভিস্যুয়াল ছাড়া, দৃশ্য ছাড়া এক মুহূর্ত যারা টিকবে না, তাদের কী করে বোঝানো যাবে যে, মন্তব্য ব্যাপারটা অত সহজ নয়? রিলের তাৎক্ষণিকতায় বিশ্বাসী জনগণকে কী করে বোঝানো যাবে, কবি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন?
‘কী খবর’ শিরোনামের একটি বক্তৃতায় অরিন্দম চক্রবর্তী একবার বলেছিলেন, খবরের ‘তাজাত্ব’ আর ‘প্রমাণ- সমর্থিতত্ব’- দুইয়ের মধ্যে তফাত আছে। প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেউ ‘কিছু প্রমাণ করতে হবে’ সিদ্ধান্ত নিয়ে নেমে পড়ে যদি তার বিপরীত তথ্য পায়, সে কি খারিজ করতে পারে সেই তথ্য? সোশ্যাল মিডিয়ায় সকলে তো প্রমাণিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ময়দানে নামছেন। ‘তাজাত্ব’-ই তো শেষ কথা বলবে সেখানে। আর যারা বুদ্ধিমান, তারা জানে, মহাজনের পথই পথ। তারা সকাল থেকে বিকেল অবধি অপেক্ষা করে কোন মত তার মত হবে, তা অনুধাবনের জন্য। তার মধ্যে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে কষ্টেসৃষ্টে একটা লেখা নামানোর পর তা চুরি গেলে তো আর কথাই নেই! শুধু দায় পালন করলে চলবে নাকি? কৃতিত্বও তো চাই!
অতএব, গয়ংগচ্ছ বাঙালির ভবিষ্যৎ নিয়ে যারা রোজ চুরুট কামড়ানো রসের কথা বলে, তারা হঠাৎই একদিন বাঙালি হয়। তার মধ্যে ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি যদি এসে পড়ে, তাহলে তো কথাই নেই। কাজেই, শেষ নাহি যে, শেষ কথা বলবে ফেসবুকই। মার্কেজ যাকে বলেন ‘পাবলিক লাইফ’, তা এইখানেই তৈরি হয় এখন। প্রাইভেট লিমিটেড, কাজেই ফেসবুকই এখন আয়না।
সেই আয়না কালো কি না, তা নিয়ে ভেবে কী লাভ?