অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মা ফিরলেন না। ফিরতে পারলেন না। তবু এই অসংবেদনের কর্কশ দিনকালে তিনি ক্ষণিকের জন্য হলেও ফিরিয়ে দিলেন সমবেদনার রাত্রিদিন। ঐন্দ্রিলা চলে গেলেন, তবু আসলে থেকেই গেলেন ভালবাসা নামের নরম একটা পৃথিবীতে।
মেয়েটা ফিরে আসুক। কায়মনোবাক্যে চেয়েছিলেন সকলেই। মেয়েটা আবার রোদ্দুরের মতো ঝলমল করে হেসে উঠুক। প্রার্থনা করেছিলেন কতজন। মেয়েটার হাতে হাত রেখে আরও একবার স্বপ্ন দেখুক প্রেমিক তার। আশা করেছিলেন কতজনে। পরিচিত, অপরিচিত কত মানুষ মনে মনে যেন প্রহর গুনছিলেন মেয়েটার ফিরে আসার।
মেয়েটা ফিরল না। ঐন্দ্রিলা শর্মা। বহু মানুষের প্রার্থনা বিফল করে ফেরার হল না-ফেরার দেশে। আর চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল কত না মানুষের।
মেয়েটা তো ফাইটার ছিল। মেয়েটা তো ফিনিক্স। সংবাদমাধ্যম তাকে এ নামেই ডাকতে ভালবাসে। ক্যানসার! হ্যাঁ তা থাবা বসিয়েছিল বটে শরীরে তার। একবার নয়, দুবার। কিন্তু তার যে আছে অফুরান জীবনীশক্তি। আর আছে ভালবাসার রক্ষাকবচ। ভালবাসাই তার জিয়নকাঠি। কত মানুষ ভালবাসে তাকে। আর আছে তার মনের মানুষ। বড় মনের সেই মানুষটা, যে জানে বিপদের দিনে কীভাবে আগলে রাখতে হয় প্রিয়জনকে। পাগলী তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব! উঁহু, প্রেমিক সে জন যেন বলে, পাগলী তোমার সঙ্গে শুটিং ফ্লোর জীবন কাটাব, পাগলী তোমার সঙ্গে হাসপাতাল কাটাব জীবন! তারায় তারায় রটে যায় তাদের কথা। মিষ্টি দুটো ছেলেমেয়েকে ভালবেসে ফেলে অপরিচিতের পৃথিবীও। তাদের বিপদ হলে ঈশ্বরকে ডেকে বলে, ওদের ভাল হোক।
মেয়েটা তবু ফিরল না। ফিরতেই তো চেয়েছিল সে। এত মানুষকে দুঃখিত করা তার ধর্ম নয়। তবু চলে যেতে হয় বলেই যেন সে চলে গেল।
মেয়েটি অভিনেত্রী। তার প্রেমিককেও দেখা যায় পর্দায়। অনেকের কাছে তারা তাই পরিচিত। অনেকের কাছেই আবার নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুনেছে তাদের কথা। শুনেছে ভালবাসাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে কেমন জীবনে ফেরার চেষ্টা করেছে তারা। পাড়ি দিতে নদী, হাল যদি ভেঙেও থাকে, ছিন্ন পালের কাছির মুখেও তারা অন্তত বলে উঠতে পেরেছে, তুমি আছ আমি আছি। এই তো সেই ঝিনুক যার ভিতর মুক্তো আছে। এই তো সেই ভালবাসা, চর্যাপদের হরিণীর মতো যাকে যুগে যুগে খুঁজেছে মানুষ। ছেলেটা আর মেয়েটার জন্য তাই মনকেমন অসংখ্য মানুষের। রক্তের টান থাক বা না-থাক, ওরা দুজন যেন হয়ে ওঠে আত্মীয়। আর ঠিক তখনই পৃথিবীটা যেন বড় হতে হতে আকাশ ছুঁয়ে ফেলে।
এই পৃথিবী ব্যক্তিকেন্দ্রিক। স্বার্থের কেন্দ্রে ভর রেখে সে পাক খায় অবিরাম। এমন বদনামই তো শোনা যায় অহরহ। চারিদিকে অসংবেদনশীলতার কত না ছবি। আহত সহ-নাগরিককে সাহায্য না করে ভিডিয়ো তোলে জনতা। প্রেম গোপনে বিষিয়ে উঠে হয়ে ওঠে হত্যাকারী। এ পৃথিবীর আছে এক কুৎসিত মুখ। তা তো অস্বীকার করা যায় না। তবু তারই বিপরীতে থাকে এই এক পৃথিবী ভালবাসা। যেখানে অনাত্মীয়ের জন্যও প্রাণ কেঁদে ওঠে। তাদের একটুকু সুখবরের জন্য আনচান করে প্রাণ। আর দুঃসংবাদে চোখে জল আসে। এ-ও আর এক পৃথিবী, যার দেখা সচরাচর মেলে না। খুব কম মানুষের জন্যই গড়ে ওঠে ভালবাসার সেই ক্ষণস্থায়ী তবু চিরকালীন অমরাবতী। ঐন্দ্রিলা সেরকমই ব্যতিক্রমী একজন।
অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মা ফিরলেন না। ফিরতে পারলেন না। তবু এই অসংবেদনের কর্কশ দিনকালে তিনি ক্ষণিকের জন্য হলেও ফিরিয়ে দিলেন সমবেদনার রাত্রিদিন। ফিরিয়ে দিলেন বড় একটা পরিবার আর আত্মীয়তার অন্য ধারণা। সেখান থেকে তাঁর চলে যাওয়া নেই। ঐন্দ্রিলা চলে গেলেন, তবু আসলে থেকেই গেলেন ভালবাসা নামের নরম একটা পৃথিবীতে।