বাস্তব সমাজে নারীরা জানেন, কীভাবে চলতে ফিরতে নানা লোভী চোখ আর নোংরা কথার মুখোমুখি পড়তে হয় তাঁদের। যে ধর্ষণ সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁদের নিত্যদিনের লড়াই, সিনে-নায়কের আচরণে সেই সংস্কৃতিরই ছাপ থাকলে তা তো একরকম ভাবে মান্যতা পেয়ে বসে। আর সেই বিষয়টি বাস্তবিক আশঙ্কার। এই প্রবণতা নিয়েই এবার মুখ খুললেন আমির খান।
নারীকে নিজেদের অধিকারে রাখা, তার উপর জোর খাটানোই নাকি ভালবাসার প্রকাশ। নারীকে উত্যক্ত করাই ‘মাচো’ ইমেজের পরিচয়। খলনায়ক নয়, নায়কের কার্যকলাপেই এই বার্তা দিচ্ছে সিনেমা। কেবল নারী নয়, যে-কোনও মানুষের সঙ্গেই যা-ইচ্ছে-তাই ব্যবহার করাই যেন পৌরুষের প্রকাশ, নায়কের মধ্যে দিয়ে সেই বক্তব্য রীতিমতো জাঁকিয়ে বসছে। আর কেবল সিনেমা কেন, সিনে দর্শকদের কাছেও এই বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা বিপুল। বক্স অফিসের ঝড় দেখেই তার আঁচ বোঝা যাচ্ছে। ‘পুষ্পা’ হোক অথবা ‘অ্যানিম্যাল’, বক্স অফিসে শুধুই উগ্র পৌরুষের জয়জয়কার। আর এই প্রবণতাটি নিয়েই এবার আক্ষেপ প্রকাশ করলেন বলিউডের তিন খানের অন্যতম, মিস্টার পারফেকশনিস্ট আমির খান।
আরও শুনুন:
‘মাকে কাজ করতে দিলে না কেন?’ সুপারস্টার বাবাকে প্রশ্ন করেছিলেন টুইঙ্কল
একসময় ‘সত্যমেব জয়তে’ নামে একটি শো-তে সমাজের নানা বিষয় নিয়েই কথা বলেছেন আমির। খ্যাতনামা সমাজকর্মী কমলা ভাসিনের সঙ্গে নারী নির্যাতন, নারীর অসম্মান নিয়েও কথা বলতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। সেই আমিরই এবার উদ্বেগ প্রকাশ করলেন ভারতীয় ছবির সাম্প্রতিক ট্রেন্ড নিয়ে। তাঁর বক্তব্য, এই ছবিগুলিতে সগৌরবে উড়ছে পুরুষতন্ত্রের নিশান। আর নারীকে সেখানে হাজির করা হচ্ছে নিছক পণ্য হিসাবে, কেবল নাচের দৃশ্যে নজরটানের জন্যই। এই ধরনের ছবি তৈরির প্রবণতা সমাজকে আরও কয়েক দশক পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলেই মত আমিরের।
আসলে, টিআরপি-কে গুরুত্ব দেওয়া বলিউড বরাবরই জানে, সিনেমা চলার জন্য নারীশরীরকে পণ্য করা তার কাছে জরুরি। বস্তুত নায়ক আর খলনায়কের লড়াই আর তার মাঝখানে নায়িকার হেনস্তা ও উদ্ধারের গল্প, এই ছকে সেই কাজটি বলিউড করেই এসেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মেল গেজকে তুষ্ট করার সেই ধরন অনেকখানি বদলে গিয়েছে। কবীর সিং কিংবা অ্যানিম্যাল-এর মতো ছবিগুলিতে দেখা যাচ্ছে, খলনায়ক নয়, নায়কের হাতেই নানাভাবে হেনস্তার মুখে পড়ছে নায়িকা। নারীকে নিজেদের অধিকারে রাখা, তার উপর জোর খাটানোকে ভালোবাসার প্রকাশ বলে দাবি করে বসেছে কবীর সিং। অ্যানিম্যাল একদিকে যেমন খলনায়ককে বৈবাহিক ধর্ষণ করতে দেখিয়েছে, অন্যদিকে নায়কের অবাধ যৌনাচারকেও প্রশ্রয় দিয়েছে। কথা হল, গল্পের প্রয়োজনে যদি বা এমন কিছু দেখাতে হত, সেখানে কোথাও এই বার্তা পৌঁছে দেওয়াও জরুরি যে এই আচরণ আদৌ মানবিক নয়। অথচ ছবিগুলির পরিচালক থেকে কলাকুশলী, কারও কথায় সেই বার্তাটুকু আসেনি। উলটে এই পৌরুষ সংস্কৃতিকেই কার্যত পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন তাঁরা। এমনিতে বাস্তব সমাজে নারীরা জানেন, কীভাবে চলতে ফিরতে নানা লোভী চোখ আর নোংরা কথার মুখোমুখি পড়তে হয় তাঁদের। যে ধর্ষণ সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁদের নিত্যদিনের লড়াই, সিনে-নায়কের আচরণে সেই সংস্কৃতিরই ছাপ থাকলে তা তো একরকম ভাবে মান্যতা পেয়ে বসে। আর সেই বিষয়টি বাস্তবিক আশঙ্কার। সম্প্রতি এ নিয়ে কথা বলেছিলেন সাংসদ তথা অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউতও। তিনিও বলেছিলেন, আজকালকার অনেক সিনেমায় নায়ক প্রায় গুন্ডার মতো কার্যকলাপ করে থাকে। তারা মেয়েদের উত্যক্ত করে, মেয়েদের তাড়াও করে কখনও কখনও, এমনকি ধর্ষণ পর্যন্ত করে বসে। আগে যে কাজগুলি খলনায়কের সঙ্গে জুড়ে ছিল, এখন নায়কের কাজে তারই ছাপ। অথচ তাদের কোনও শাস্তি হওয়া তো দূর, তারাই সিনেমা জুড়ে হাততালি কুড়িয়ে নেয়।
এই প্রবণতা নিয়েই এবার মুখ খুললেন আমির খানও। তিনিও বলছেন, যুক্তি যে কাজ করতে পারে না, গল্প তা পারে। ফলে ছবির মাধ্যমে মানুষের ভ্রান্ত বা অনৈতিক ধ্যানধারণার পরিবর্তনের চেষ্টা করা যায়। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনও যে পুরুষতন্ত্র বাসা বেঁধে আছে, তা তো একদিনে উধাও হয়ে যাবে না। কিন্তু অপর একজন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া যে ভালো কথা নয়, সে বিষয়টি তো নানাভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আর সিনেমা সে কাজ করতে পারে। তার বদলে, যেভাবে নায়কের চরিত্রের সঙ্গে সিনেমায় জুড়ে যাচ্ছে উগ্র পৌরুষের আস্ফালন, তা আদতে গোটা সমাজকেই ভাবনাচিন্তায় পিছিয়ে দিচ্ছে, এমনটাই মনে করছেন মিস্টার পারফেকশনিস্ট।