এক মেয়েকে যখন নির্যাতন নৃশংসভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে, তখন সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়েই অন্যান্য মেয়েরাও নিজেদের বিপন্নতাকে চিনে নিচ্ছেন নতুন করে। আর এই প্রেক্ষিতেই ফিরে এসেছে ঋতুপর্ণের জন্মদিন। এই আবহে মনে করে নিতে হচ্ছে তাঁর ‘দহন’-কেও।
মেয়েদের অনেক ভয়। ঘরে, বাইরে। একেক জায়গায় একেকরকমভাবে সে বিপন্ন হয়। একেকভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়। কেউ সেই বিপন্নতাকে সইতে সইতে বাঁচে। কেউ বিপন্নতার বিরুদ্ধে গলা তোলে। আর কাউকে কাউকে সেই বিপন্নতা একেবারে গিলে ফেলে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি আমাদের সামনে সেই বিপন্নতাকেই বেআব্রু করে দিয়েছে। প্রশ্ন তুলেছে, ঘরে বাইরে কোনও জায়গাতেই কি নিজেদের নিরাপদ বলে মনে করতে পারেন মেয়েরা? মেয়েরা, এবং যে কোনও প্রান্তিক যৌনতার মানুষ এর উত্তরে বলছেন, না। এক মেয়েকে যখন নির্যাতন নৃশংসভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে, তখন সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়েই অন্যান্য মেয়েরাও নিজেদের বিপন্নতাকে চিনে নিচ্ছেন নতুন করে। আর এই প্রেক্ষিতেই ফিরে এসেছে ঋতুপর্ণের জন্মদিন। এই আবহে মনে করে নিতে হচ্ছে তাঁর ‘দহন’-কেও।
সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সমনামের উপন্যাস থেকে তৈরি ‘দহন’ ছবিটি, যেখানে প্রকাশ্য মেট্রো স্টেশনে যৌন হেনস্তার শিকার হয়েছিল তরুণী বধূ রোমিতা। আমরা জানি, যে কোনও হেনস্তার ঘটনায় প্রথম প্রশ্ন ওঠে, মেয়েটি ওই সময়ে ওখানে কী করছিল। প্রশ্ন ওঠে, তার পরনের পোশাকটি সমাজের মাপকাঠিতে ‘ভদ্রসভ্য’ কি না। নির্ভয়া কাণ্ডে প্রশ্ন উঠেছিল, সে প্রেমিকের সঙ্গে বেরিয়েছিল কেন। বিজেপি নেতা নিদান দিয়েছিলেন, স্বামী কিংবা আত্মীয় ছাড়া মেয়েদের কোনও পরপুরুষের সঙ্গে বেরোনো উচিত নয়, তাহলেই ধর্ষণ আটকানো যাবে। রোমিতা কিন্তু শাড়ি পরে ছিল। স্বামীর সঙ্গে ছিল। কিন্তু পোশাক কিংবা পুরুষ, কেউই তাকে অন্য পুরুষের লোভের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে পারেনি। যৌন হেনস্তার হাত থেকে রোমিতাকে বাঁচাতে ছুটে এসেছিল আরেক মেয়ে, ঝিনুক।
এই যে এক মেয়ের নির্যাতনের বিচার চেয়ে পথে নেমেছেন অন্য মেয়েরা, রাত দখল থেকে ডাক দিয়েছেন অধিকার দখলের, ঝিনুকও কিন্তু রোমিতার জন্য বিচার চেয়েই গোটা ছবি জুড়ে লড়াই করে চলেছিল। রোমিতা বেঁচে ছিল বটে, কিন্তু নিজের জন্য সরব হওয়ার অবস্থায় ছিল না সে। তার কারণ ভয়। বাইরে একরকমভাবে বিপন্ন হয়েছিল সে, ঘর বা ঘরের মানুষেরাও তাকে আরেকরকম বিপন্নতার দিকেই ঠেলে দিয়েছিল। সে বিপন্নতা এসেছিল ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা থেকে। সারা ছবিতে ট্রমায় আচ্ছন্ন থাকা রোমিতা তার নিজের কথা কেবল বলতে পারত চিঠিতে, শেষ চিঠিতে সে এই ভয়ের কথাই বলেছিল, লিখেছিল ‘কত ভয় আমাদের!’ প্রায় একই রকম কথা বলেছিল ঝিনুক, ‘আমার খুব ভয় করছে ঠাম্মি।’ ছবির শেষে এসে। সারা ছবিতে বাইরের হেনস্তার সঙ্গে লড়াই করে আসা ঝিনুক ভয় পেয়েছিল তার প্রেমিকের আচরণ নিয়ে, তার আসন্ন বিয়ে বা সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে।
বস্তুত, নিজের সমগ্র সিনে-যাত্রা জুড়েই নারী-সহ প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের বিপন্নতাকে চিনতে এবং চেনাতে চাইছিলেন ঋতুপর্ণ। ‘দহন’ ছবিতে সে কথা বড় বেশি করেই আছে। বড় স্পষ্ট সে বিপন্নতা। তবে নয়ের দশকের মধ্যপর্বে তৈরি নিজের এই তৃতীয় ছবিটিতে, একা হয়ে যাওয়ার বিপন্নতার সঙ্গে সঙ্গে তা পেরিয়ে একা বেঁচে থাকার কথাও বলেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। আজ এই বিপন্নতার মাঝে, ত্রস্ত হতে হতেও পালটা বেঁচে থাকার পথ খুঁজছি আমরা। ‘দহন’-এ ঝিনুক বলেছিল একলা চলার অভ্যেস জারি রাখার কথা, ছবির শেষে রোমিতাও লিখেছিল, ‘একা চলার আনন্দটুকু পেতে চাই এবার, একা চলার ভয়টাই এতদিন শুধু পেয়েছি।’ রাস্তায় একাকী পা ফেলার এই অধিকার মেয়েদের এই যাবতীয় নির্যাতনের অর্জন। যে নির্যাতন মেয়েদের বেঁচে থাকার পথে কাঁটা দিতে চায়, সেই মারের মুখের উপর দিয়ে জীবনের আলো ফুটিয়ে চলেছেন মেয়েরা। ‘দহন’ ছবিটিকে মেয়েদের বিপর্যয়ের ছবি তো বটেই, কিন্তু তার তলায় মেয়েদের সেই বাঁচার অভিপ্রায়ও হয়তো কবুল করতে চেয়েছিলেন ঋতুপর্ণ। সাম্প্রতিক বিপন্নতা আর বিপন্নতাকে পেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে মনে থাকুক সেই ‘দহন’-এর বয়ানটিও।