প্রতিভা তো ছিলই, তারই সঙ্গে ছিল গান নিয়ে পড়াশোনা আর নিরন্তর চর্চা। এ সবকিছুর মিশেলে নিজের মধ্যে যে ক্ষমতার বলয় তৈরি করেছিলেন রাহুল দেব বর্মণ, তা-ই তাঁকে বরাবর বাঁধা গত ভেঙে অন্য রাস্তায় গান বাঁধার স্বপ্নকে সুরে ভাসিয়েছিল। সে সুরেই পঞ্চমে বেজে উঠেছিল ভারতীয় গানের জগৎ।
শিল্পী সুর চেনেন। তবে বড় শিল্পী সুর খুঁজে আনতে জানেন। নিত্যদিনের কাজের জগতে থাকা যেসব জিনিস নেহাতই বেসুরো, তাকেও তাঁরা সুরের সংগতে কাজে লাগিয়ে ফেলেন। সুর খুঁজে নেওয়ার তেমনই প্রতিভা ছিল রাহুল দেব বর্মণের। প্রতিভা তো ছিলই, তারই সঙ্গে ছিল গান নিয়ে পড়াশোনা আর নিরন্তর চর্চা। এ সবকিছুর মিশেলে নিজের মধ্যে যে ক্ষমতার বলয় তৈরি করেছিলেন তিনি, তা-ই তাঁকে বরাবর বাঁধা গত ভেঙে অন্য রাস্তায় গান বাঁধার স্বপ্নকে সুরে ভাসিয়েছিল।
আরও শুনুন:
দূরে কোথাও দু-এক পশলা সুমন হচ্ছে…
পঞ্চমের এমন অভিনব ভাবনাচিন্তার ঠেলায় সোডার বোতল অবধি রেহাই পায়নি। খুশবু সিনেমায় ‘ও মাঝি রে’ গানটা তৈরি হবে তখন। ছবির দৃশ্যগুলো কেমন হবে, শুনতে শুনতে অসংখ্য প্রশ্ন ঝালিয়ে নিচ্ছেন সুরকার। নদীটা কেমন, তার পাশে গ্রাম আছে কি না, সে গ্রামের জীবনধারাই বা কেমন, সবকিছু নিয়েই তাঁর কৌতূহল যেন ফুরোয় না। গানের সুরই তো করবেন, তার জন্য এত কিছু জানার দরকার কী! সে কথা মানতে নারাজ পঞ্চম। পুরো ছবিটা তাঁর চোখের সামনে ফুটে না উঠলে সুরেও যে সেই জীবনের ছোঁয়া লাগবে না। রাহুলকে সেদিন যিনি এই দৃশ্য বোঝাচ্ছিলেন, সেই গুলজার পরে বলছেন, “কথা বলতে বলতে ও আমায় হঠাৎ বলল, ‘আচ্ছা, গ্রামে পানচাক্কি থাকে না, তার একটা সাউন্ড করলে কেমন হয়?’ আগেকার গ্রামে জলের ফোর্স দিয়ে পেষাই-কল চালানো হত, সেটাকে বলত পানচাক্কি। সেই পানচাক্কির ডিটেল এক জন সুরকারের মাথায় এ ভাবে আসতে পারে!” কেন সেই যন্ত্রের কথা মাথায় এসেছিল রাহুল দেব বর্মণের? তার উত্তর পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গেই, “একটা অলস রোজকার মানডেন জীবন বোঝাতে একটা ঘ্যানঘেনে মোনোটোনাস শব্দ খুব সাহায্য করে।” অতএব চেয়ে পাঠালেন দু’বোতল সোডা। এই ভর দিনের বেলাতেই পানের আসর বসবে নাকি, ভেবে সকলে শঙ্কিত। উঁহু, শিল্পী তখন মনে মনে সাজিয়ে ফেলেছেন তাঁর সৃষ্টিকে। বোতলের সঙ্গেই আমদানি করলেন একটি বালতির। উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে দেখলেন, দুটি বোতল থেকে একটু করে সোডা ঢেলে দিচ্ছেন, তারপর ফুঁ দিয়ে বাজাচ্ছেন। দু’বোতলে সোডার স্তর আলাদা, আর সে দুয়ের মেলবন্ধনেই তৈরি হচ্ছে এক অদ্ভুত যান্ত্রিক একঘেয়ে স্বর। সেই সুরই শেষমেশ ব্যবহৃত হয় গানটিতে।
আরও শুনুন:
‘কবিতা তো আর স্ন্যাক্স নয়!’ মৃদুভাষে সেদিন বলে উঠেছিলেন গুলজার
একইভাবে ‘ধন্নো কি আঁখো মে চাঁদ কা চুম্মা’ গানের সুর তৈরির সময়ও প্রয়োজন হয়েছিল যান্ত্রিক শব্দের। সেখানেও হাজির গুলজারই। তিনি চেয়েছিলেন গানের সুর যেন এমন হয়, যাতে ট্রেন চলার নস্টালজিয়া বারবার মনের মধ্যে ফিরে আসে। আর ডি ঠিক করলেন, গোটা গানে একটিমাত্র বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করবেন। সেসময় নতুন একটি ডাবল-নেক গিটার আনিয়েছেন। যদিও তার সুর নিয়ে গুলজারের মনে সংশয়, ট্রেনের মতো মনে হচ্ছে না তো। বুদ্ধি জোগালেন রাহুলই, সিনেমায় ট্রেন যাওয়ার দৃশ্যে সে সুর আগেই ব্যবহার করা হোক। তাহলে পরে যতবারই সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ডে সে সুর বাজবে, তার সঙ্গেই ফিরে আসবে ট্রেন যাওয়ার স্মৃতি। গুলজার বলেছিলেন, আসলে নিজের আত্মা দিয়ে সুরকে বুঝতেন বলেই সুর নিয়ে এমন খেলা করতে পারতেন রাহুল দেব বর্মণ।
তাঁর গানে উঠে এসেছিল সারা পৃথিবীর সুর। সে সুরের আন্তর্জাতিক চলন নিয়ে অনেক কথাই হয়। কিন্তু দেশের মাটিকেও অন্তর দিয়ে চিনে নিতে নিতেই তার যাপনকে এমনভাবে সুরে বাঁধতে পারতেন তিনি। সুরের আকাশে চিরদিনের এক ধ্রুবতারাই তিনি, রাহুল দেব বর্মণ।
[ঋণ: পান্তাভাতে: গুলজার]