সোমবার বাংলাদেশে প্রয়াত হলেন বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার হিসেবে বাংলা সাহিত্যে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন তিনি। বাংলা কথাসাহিত্যের তিনি এমন একজন শিল্পী, সময়কে ধারণ করেই যিনি ছাপিয়ে যেতে পারেন সমসময়কে। তাঁর আখ্যান তাই সময়ের দলিল শুধু নয়, এই সভ্যতার মানবতার ঋত ও শাশ্বত স্বর নিহিত হয়ে আছে লিখিত শব্দমালায়।
দেশ যে কী করে আলাদা হয়ে যায়, এ প্রশ্নের উত্তর কেউ বুঝিয়ে দেয়নি ‘আগুনপাখি’র সেই বৃদ্ধাকে। এ প্রশ্ন কি শুধু একটি চরিত্রের? একজন মানুষের? নাকি সমগ্র মানবতার? সমষ্টির ইতিহাসের? আজ আমরা বুঝি, চরিত্রের মুখে ঝুলতে থাকা জিজ্ঞাসা কেবল নয়, ইতিহাসের দিকেই চিরকালের জন্য এ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক।
আরও শুনুন: রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মঞ্চে নগ্ন হওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন সাবিত্রী
তিনি এমন একজন লেখক, যাঁর লেখার শরীরে গভীরভাবে ছাপ ফেলেছিল সময়। ১৯৩৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় তাঁর জন্ম, পরে তাঁর পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস শুরু করে। ফলে স্বাধীনতা এবং দেশভাগের সাক্ষী হতে পেরেছিলেন তিনি। আবার যখন তিনি কলেজের ছাত্র, সেই সময় থেকেই পাকিস্তানে ফের ঘনিয়ে উঠছিল বিদ্রোহের আগুন। ভাষার অধিকারের দাবিতে মুখর হয়ে উঠছিল পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা। ছাত্রাবস্থাতেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে পাকিস্তান সেনার হাতে নির্যাতিতও হয়েছিলেন আজিজুল হক। এহেন সময় এবং সমাজে যাঁর বেড়ে ওঠা, তাঁর লেখক সত্তাটিকে গড়ে তুলেছিল ওই পরিস্থিতিই। তাঁর কথায়, “গল্প লেখার সময় আমি তাকাই আমার ভেতরের দিকে। সেখানটায় গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করি। আমার ভিতরে আমি দেখি রয়েছে- মানুষ এবং সমাজ।” তাই তাঁর কলমে একদিকে ফিরে ফিরে আসে দেশভাগের ক্ষত, রাজাকারদের বীভৎস অত্যাচারের ছবি, আর আরেকদিকে স্থান-কালের গণ্ডি পেরিয়ে কেবলই মানুষ, তার যন্ত্রণা, অসহায়তা, অমানবিকতার ছবি।
আর এই ছবি-লেখার শুরু মাত্র ১৮ বছর বয়সেই। কলকাতায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে একটি সাহিত্য প্রতিযোগিতার আহ্বান করা হয়েছিল। দৌলতপুর বিএল কলেজের সম্মান শ্রেণির পড়ুয়া আজিজুল ততদিনে রীতিমতো জড়িয়ে পড়েছেন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে। কিন্তু সে রাজনীতি কোনও দলের বিরুদ্ধে নয়, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দি, যিনি ছিলেন স্বাধীনতার আগেকার গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর নায়ক, তাঁর সাম্রাজ্যবাদী অবস্থানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এই ছাত্ররা। এই সময়েই ‘শামুক’ নামে তাঁর প্রথম উপন্যাস লেখেন আজিজুল, যখন পাকিস্তান সেনার হাতে নিগ্রহের ফলে তাঁর শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা আর জ্বর। প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থান অর্জন করে নেয় তরুণ আজিজুলের লেখা সেই প্রথম উপন্যাস। যিনি পরে বলেছিলেন, লিখতে শুরু করার আগে অন্যান্যদের লেখা পড়ার বিশেষ সুযোগই হয়নি তাঁর। কারণ গ্রামে থাকার কারণে বিখ্যাত সাহিত্যিকদের বইপত্র তিনি সংগ্রহ করতে পারতেন না। তাই লেখার ক্ষেত্রে সবসময় তাঁকে নিজের জীবনের দিকেই তাকাতে হয়েছে। আজিজুল বলেছিলেন, “সেখানে আমি এক জীবনের ভিতর দিয়েই অনেক জীবন দেখেছি।” একইভাবে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘আগুনপাখি’-র পটভূমি হয়েছে ‘৪৭-এর দেশভাগ। তিনি মনে করতেন, দেশভাগ পূর্ব পাকিস্তানের ৮৫ ভাগ মুসলমানের কোনও কাজে আসেনি, বরং ক্ষতি করেছে। আবার ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে এক কিশোরীর ধর্ষিতা হওয়ার বাস্তব ঘটনা। তাঁর মনে হয়েছিল এমন লজ্জাজনক ঘটনার দায় সমগ্র পুরুষজাতির, এবং সেই হিসেবে তাঁরও। বইয়ের উৎসর্গপত্রে তাই সাবিত্রী নামের সেই কিশোরীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন লেখক স্বয়ং।
আরও শুনুন: ‘লবেঞ্চুস মার্কা হিরো’ নয়, নায়কের ধারণায় বদল আনার নায়ক সৌমিত্রই
এমন মানবিক অনুভূতিতে জারিত হয় যে লেখকের কলম, তাঁর মৃত্যু যে অমোঘ শূন্যতার জন্ম দেয় তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এ কথাও সত্যি, লেখকের মৃত্যু হলেও আত্মার মতোই অবিনশ্বর হয়ে থেকে যায় তাঁর অক্ষরেরা। আর তার মধ্যে দিয়েই বেঁচে থাকেন লেখকও। যেমন থাকবেন হাসান আজিজুল হক, দুই বাংলার সব পাঠকের মনে তো বটেই, তিনি থাকবেন আগামী লেখকদের লেখক হয়েও।