সচেতনভাবে নাটক বারে বারে প্রতিবাদের কথা বলেছে। রাজনৈতিক প্রতিবাদের এক দীর্ঘ ইতিহাসকে ধারণ করে আছে নাটক। আজ যদি সেই নাটককে দরকারে অদরকারে প্রায় অপশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়ে যায়, তাহলে সন্দেহ হয়, তা আসলে সেই প্রতিবাদের অস্ত্রকে ভোঁতা করে দেওয়ারই চাল নয় তো?
‘শর্ম্মিষ্ঠা’ নাটকের প্রস্তাবনায় ‘অলীক কুনাট্য’ কথাটি লিখেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সেই কথার অনুষঙ্গ কথায় কথায় টেনে এনে থাকি আমরা। কোনও অপছন্দের ঘটনার প্রেক্ষিতে আচমকা বলে বসি, নাটক বন্ধ কর, কিংবা নাটক করা হচ্ছে! এই যেমন ধরুন, ইডি হেফাজত থেকে কেজরিওয়াল সরকারকে নির্দেশ দিলেন, ফ্রি ওষুধের জোগান যেন বন্ধ না হয়। অমনি বিজেপি শিবির থেকে উড়ে এল কটাক্ষ, নাটক হচ্ছে! আবার ভোটের আগে কোনও দাপুটে নেত্রী আহত হলেন, সেখানেও একই কটাক্ষ। ভোটের গরম বাজারে এ পক্ষের জনকল্যাণ প্রকল্পও ও পক্ষের কাছে নাটক, আবার ও পক্ষের কড়া স্লোগানও এ পক্ষের মতে নাটুকে। বোঝাই যায়, এই সব ক্ষেত্রেই নাটক শব্দে সেই ‘কুনাট্যের’ ইশারা। নেতা থেকে জনতা সবাই যেভাবে এলোপাতাড়ি ‘নাটক করবেন না’ নিদান হাঁকেন, তাতে মনে হয়, ‘নাটক’ শব্দটাই যেন অপশব্দের ভাঁড়ারে নয়া সংযোজন।
আরও শুনুন:
অথচ নাটকের দীর্ঘ ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেখানে কুনাট্যের ভাগ যতখানি, তার চেয়ে অনেক জোরালো হয়ে আছে জীবনের যোগ। জীবনে যা কিছু ধুলো-মাটির গল্প, নাটক তাকে এড়িয়ে গেলে তখনই তাকে ‘অলীক কুনাট্যরঙ্গ’ বলে নিন্দা করা হয়েছে। তাই সচেতনভাবে নাটক বারে বারে প্রতিবাদের কথা বলেছে। রাজনৈতিক প্রতিবাদের এক দীর্ঘ ইতিহাসকে ধারণ করে আছে নাটক। আজ যদি সেই নাটককে দরকারে অদরকারে প্রায় অপশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়ে যায়, তাহলে সন্দেহ হয়, তা আসলে সেই প্রতিবাদের অস্ত্রকে ভোঁতা করে দেওয়ারই চাল নয় তো?
নাটুকে প্রতিবাদের খতিয়ানটা ঠিক কেমন? দেখা যাচ্ছে, পাঁচশো বছর আগে স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ জানাতে নগর-সংকীর্তন দেখেছে নবদ্বীপ। সে তো আখেরে নাটকই। সাহেবি আমলের কলকাতার বাবু কালচার কিংবা সাহেবি অত্যাচারকে খোঁচার পর খোঁচা দিয়েছে সঙের গান, তাকেও তো নাটকই বলতে হবে। সে ধারায় যতই লাগাম পরানোর বন্দোবস্ত করা হোক, তবুও সামাজিক অসংগতি নিয়ে নাটক করার রেওয়াজকে টুঁটি টিপে মারা যায়নি। ধনীর আঙিনা থেকে সরে পাবলিক থিয়েটার চালু হওয়ার পর তা আরও বেড়েছে। কখনও ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ নাটকে ব্রিটিশ ও ভারতীয় বাবুদের একযোগে ব্যঙ্গ করা হয়েছে, কখনও আবার ‘সিরাজদৌলা’ নাটক সাম্প্রদায়িকতাকে নাকচ করে ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ের বার্তা দিয়েছে, কখনও আবার কালোবাজারের বানানো দুর্ভিক্ষ নিয়ে গলা তুলেছে ‘নবান্ন’। IPTA-তে প্রতিবাদী নাটক বা অ্যাজিট-প্রপ থিয়েটার সরাসরি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। আবার বাম রাজনীতির ছত্রছায়ায় পথনাটকের প্রচার ও প্রসার হয়েছে কয়েক দশক জুড়ে। ১৯৫১-র প্রথম সাধারণ নির্বাচনে পথে নেমে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে তুলোধোনা করতেন পরেশ ধর, পানু পালরা। বহুব্যবহারে জীর্ণ হলেও, এ কথা সত্যি যে, নাটক আদতে সমাজের দর্পণ। থিয়েটারে লোকশিক্ষে হয়, এ কথাকে তাই উড়িয়ে দেওয়ার জো নেই।
আরও শুনুন:
‘অনুদান হারানোর ভয়েই কেউ কেউ নীরবতা শ্রেয় মনে করছেন’
আর সেই কারণেই আসলে, নাটককে ভয় না পাওয়ার জো নেই ক্ষমতারও। সেই ভয় কখনও শিল্পীদের জেলে ঢুকিয়েছে, আবার কখনও বা শিল্পীকে হত্যা করেছে। ১৮৭৬ সালে নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন জারি করে বিরোধী স্বর পিষে দিতে চেয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। এখনও, প্রতিটি রাজ্য সরকারের হাতে নাটক থামানোর ক্ষমতা আছে এই আইনের সুবাদেই। ১৯৬২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিদ্ধান্ত নেন, পুরোনো নাট্য আইনের নাম বদলে তাকে আরও কড়া করে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ড্রামাটিক পারফরম্যান্সেস বিল’ আনা হবে। আন্দোলনের জেরে বিলটিকে থামানো যায় বটে, কিন্তু নাটক থামানো বন্ধ হয়নি। ১৯৬৯ সালে, অর্থাৎ সত্তর দশকের ঠিক আগের উত্তাল সময়ে, এই আইনের দৌলতে বন্ধ হওয়া নাটকের সংখ্যা ১১৩৬। ১৯৭৪-এ ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রশাসন ও গুন্ডাবাহিনীর মদতে। আইনের জাঁতাকল দৃঢ় করতে দেশে নেমে আসে অন্তবর্তীকালীন জরুরি অবস্থা। মঞ্চের সঙ্গে সঙ্গে কার্জন পার্কে, কলকাতার পথেঘাটে ছোটখাটো নাট্যদলগুলির নিয়মিত অভিনয় বন্ধ হয়ে যায়। শুধু সরকারি দমননীতি নয়, সমাজের মোড়ল থেকে রাজনৈতিক মস্তান, অনেকেই নাটক বন্ধ করতে চেয়েছে। কিন্তু কোনও কিছু করেই কি নাটককে রুখে দেওয়া গিয়েছে? এমার্জেন্সির সময়ে কার্যত আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে অভিনীত হয় বাদল সরকারের ‘ভোমা’। ছয়টি শো, ছয়টিই হাউজফুল। যেখানে অভিনয় চলাকালীন সফদর হাশমিকে গুলি করা হয়েছিল, সফদরের মৃত্যুর ঠিক পরে জন নাট্য মঞ্চ সেই একই জায়গায় ফিরে গিয়ে নাটকের অভিনয় সম্পূর্ণ করে। এই প্রতিরোধকে শাসক ভয় পায় বইকি! আর তাই হয়তো, প্রত্যক্ষ দমননীতির আড়ালেও চালু থাকে একধরনের পরোক্ষ কার্যক্রম। ধোলাইয়ের তরলীকৃত অসভ্যতা হয়ে নেমে আসে মগজধোলাই। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে লঘু করে তাকে হারিয়ে যেতে দেওয়ার চক্রান্ত। ‘নাটক’ শব্দের এলোপাতাড়ি প্রয়োগ দেখলে সেই ষড়যন্ত্রের কথা ভেবে সচেতন থাকাও কিন্তু জরুরি।