মানুষের পৃথিবীতে মানচিত্রের বিভাজন। জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের হরেক কুঠুরি। নানা কারণেই মানুষ সেই অলাতচক্রে ঘুরে মেরে। এই বিভাজনদুষ্ট পৃথিবীতে সংগীত যেন পরম উপশম। যা শুদ্ধ করে আমাদের অন্তর। পরিশ্রুত করে বোধ। আর তাই সংগীত দিবস আমাদের কাছে যেমন সুরের উদযাপন, তেমনই বিভাজনহীন এক উদার সাম্যের পৃথিবীর স্বপ্ন দেখারও দিন। আলোচনায় সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।
উপমহাদেশের প্রবাদপ্রতিম সুরসাধাক উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব গাইছেন ‘হরি ওম্ তৎ সৎ’। কী নিমগ্ন সেই উচ্চারণ! সুরের সেই স্বর্গীয় বিভা যেন আমাদের শ্রুতিকে পবিত্র করে। একই তন্ময়তায় পণ্ডিত ভিমসেন যোশি গেয়ে ওঠেন আল্লা-উপাসনা ‘করিম নাম তেরো… ‘। পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা যখন আঙুলে নামিয়ে আনেন মা সরস্বতীকে, তখন বাগ্দেবীই যেন আবির্ভূতা হন উস্তাদ জাকির খানের তালবাদ্যে। সন্ধান করে এই যুগলবন্দির নমুনা যে আজ তুলে আনতে হচ্ছে, তা যেমনই সৌভাগ্যের, তেমন দুর্ভাগ্যেরও। দুর্ভাগা সেই দেশ যেখানে কেবল বীরেরই দরকার হয়, আর দুর্ভাগা সেই দেশ যেখানে সম্প্রীতির উদাহরণ দরকার হয়ে পড়ে সংগীতের সূত্রে। তবে নানা কারণে আমাদের চারপাশে যে বিদ্বেষ-বাতাবরণ, যে অসহিষ্ণুতার আবহ তাতে সংগীতের এই উদার পৃথিবীর কথা জোর দিয়ে বলা বুঝি বা জরুরিই হয়ে উঠেছে। আসলে সংগীত হল সেই পথ যা মানুষকে স্থবিরতা থেকে মুক্তি দেয়। মুক্তি দেয় চিন্তার আবিলতাকে, ভাবনার একমাত্রিকতাকে। ধর্মের বিদ্বেষ মুছে সংগীত মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে সেই অনির্বচনীয় প্রদেশে, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের আঙিনাগুলো মুছে গিয়ে জেগে থাকে মানুষের ধর্ম।
আর তাই যুগে যুগে গণমানুষের মুক্তিতে বড় ভূমিকা নিয়েছে সংগীত। পাশ্চাত্যে সাদা-কালো মানুষের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছিল সংগীতই। প্র্যাচ্যেও সেই একই ছবি। কীর্তনের সুর যেমন মিলিয়ে দিয়েছিল বহু মানুষকে, তেমনই ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে রবি ঠাকুরও হাতিয়ার করেছিলেন সেই সংগীতকেই। পরবর্তী কালে গণমুক্তির স্বপ্ন দেখায় দোসর হয়েছিল গণসংগীত। সংগীত যেমন জনমানস থেকে উঠে আসে, তেমনই মিশে যেতে পারে জনতার মুখরিত সখ্যে। সংগীত এমনই শক্তিধর। বিনোদনের সীমা ছাড়িয়ে তা পৌঁছে যেতে পারে অন্য ভূমিকায়।
যুগে যুগে তাই সংগীতের ধারা প্রবাহিত হয় মানচিত্র মিথ্যে করে। এক দেশের সুর মিশে যায় অন্য দেশের সংগীতে। মোজার্ট মিশে যান সলিল চৌধুরী কিংবা রাহুল দেব বর্মণে। সংগীত এমনই সম্মিলনের বার্তা দেয়। বার্তা দেয় সমন্বয় ও সাঙ্গীকরণের। বিশ্ব সংগীত দিবসে সুরের গভীর চলায় আমরা যদি সেই বোধে পৌঁছাতে পারি, তবেই মানুষে পেতে পারে অন্য এক পৃথিবী ।