কার্ল সাগান এই পৃথিবীটাকে চিনিয়ে বলেছিলেন, মহাবিশ্বে ওই তো আমাদের একমাত্র ঘর। আসুন, তাকে একটু আগলে রাখি। সত্যি বলতে, সংকটের এই মুহূর্তে এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও মন্ত্র নেই। সভ্যতাগর্বী মানুষ যেন নিজের অস্তিত্বরক্ষার কারণেই এবার অন্তত বলে উঠতে পারে, ফিরে এসো চাকা- প্রকৃতির কাছে, পরিবেশের কাছে, মা-পৃথিবীর কাছে।
একরত্তি ওই বিন্দুটির দিকে তাকিয়ে দেখো। ওই যে ওইখানে। ওইটাই আমাদের ঘর। ওখানেই থাকি আমরা। আমাদের ভালোবাসার মানুষ, আত্মজন, যাঁদের জানি-চিনি, যাঁদের কথা শুনেছি, যাঁরা এককালে ছিলেন, সকলের আশ্রয় ওই একটি মাত্র বিন্দু। আমাদের হাসি-কান্না জমাট বেঁধে আছে ওইখানে; কতশত ধর্মবিশ্বাস, আদর্শ, মতবাদ, নীতি, অর্থনীতির সূত্রাবলি… প্রত্যেক শিকারি, নায়ক, কাপুরুষ, স্রষ্টা, সভ্যতা ধ্বংসকারী, প্রত্যেক রাজা, কৃষক, ভালোবাসায় মিশে যাওয়া প্রতিটি যুগল, মা-বাবা, আগামীর শিশু, প্রত্যেক শিক্ষক, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, সুপারস্টার, সুপ্রিম লিডার, পাপী-তাপী, সন্ন্যাসী- সবকিছু, সবাই আছে ওই বিন্দুটিতে- সূর্যপ্রভায় লেগে থাকা একফোঁটা ধুলোর মতো ওই বিন্দুটিতে। – মহাকাশ থেকে ধূসর বিন্দুটির মতো জেগে থাকা পৃথিবীটাকে দেখে পৃথিবীর মানুষের জন্য এ কথাই বলে গিয়েছিলেন কার্ল সাগান। ওই বিন্দুমাত্র ঘরেই তো ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে, আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে’। এ মহাবিশ্বে আর তো কোথাও প্রাণের স্পন্দন নেই। থাকলেও আমাদের জানা নেই। কোথায় পালিয়ে আর বাঁচতে পারি আমরা! না, পালাবার পথ নেই। ওই একরত্তি ঘরটিরই যত্ন নেওয়ার কথা ছিল আমাদের। মহাবিশ্বে আমাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল, আমাদের বাসভূমি, আমাদের মা-পৃথিবী, বসুন্ধরা।
সেই বসুন্ধরা কি ভালো আছে? আমরা জানি, নেই। আমরাই তাঁকে ভালো থাকতে দিইনি। স্বেচ্ছাচারী মানুষের সভ্যতার চাকা যত গড়িয়েছে, তত ছিঁড়ে ছিঁড়ে গিয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নাড়ির যোগ। মাটি-জল-আকাশ-বনতল-বন্যপ্রাণ নিয়েই প্রাণের সংসার। মানুষ তার বাইরে নয়। তবু সম্ভোগ-লিপ্সায় মানুষ যেন বেছে নিয়েছে অয়দিপাউস-নিয়তি। প্রকৃতি-পরিবেশ-মানুষের যূথবদ্ধতা ভেঙে মানুষ যত নিজেকে ক্ষমতাশালী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তত সে ধ্বংস করেছে পৃথিবীকেই। নিজেই নিজের অস্তিত্বকে করে তুলেছে সংকটময়। কার্ল সাগান ঠিক সেই জায়গাটির কথাই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন মানুষকে। এত যে হানাহানি, প্রতিযোগিতা, এই যে এক্কাদোক্কা, সাপলুডো তা তো প্রাণ আছে বলেই। তাই-ই যদি না থাকে, মহাবিশ্বের এই একবিন্দু ঘরটাই যদি আর না থাকে, তাহলে তো সব কিছুই মিলিয়ে যায় এক নিমেষে। সাগান তাই বলেছিলেন, জ্যোতির্বিজ্ঞান আমাদের আর একটু বিনয়ী হতে শেখায়। পরস্পরের প্রতি যেন আমরা আর একটু সহৃদয় হই। যেন আর একটু যত্ন নিই আমাদের ধূসর-বিন্দু ঘরটির।
তবে, সত্যি বলতে সেই যত্ন নেওয়া থেকে আমরা ক্রমশ বহু বহু দূরে। পরিবেশ-প্রকৃতি নিয়ে আমাদের ভাবনা যেন ব্রাত্যজনের রুদ্ধকথা; তার গুরুত্ব বুঝতে অসুবিধা হয় না, তবে সেটিকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনা কিছুতেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। মানুষের লোভই সে পথে প্রধান অন্তরায়। যে ধনতান্ত্রিক কাঠামোর মানুষ নিজের জন্য তৈরি করেছে, প্রকৃতিকে যথেচ্ছ ব্যবহার করতে সেই আত্মধ্বংসী প্রক্রিয়া দ্বিধা করে না। সেই সঙ্গে ভুলিয়ে দিতে থাকে যে, প্রকৃতির প্রতি মানুষেরও কিছু কর্তব্য ছিল। শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণ ও বৃক্ষরোপণ-উৎসবে রবীন্দ্রনাথ একেই উল্লেখ করেছিলেন ‘অভিসম্পাত’ হিসাবে; বলেছিলেন, “মানুষ অমিতাচারী। যতদিন সে অরণ্যচর ছিল ততদিন অরণ্যের সঙ্গে পরিপূর্ণ ছিল তার আদানপ্রদান; ক্রমে সে যখন নগরবাসী হল তখন অরণ্যের প্রতি মমত্ববোধ সে হারাল; যে তার প্রথম সুহৃদ্, দেবতার আতিথ্য যে তাকে প্রথম বহন করে এনে দিয়েছিল, সেই তরুলতাকে নির্মমভাবে নির্বিচারে আক্রমণ করলে ইঁটকাঠের বাসস্থান তৈরি করবার জন্য। আশীর্বাদ নিয়ে এসেছিলেন যে শ্যামলা বনলক্ষ্মী তাঁকে অবজ্ঞা করে মানুষ অভিসম্পাত বিস্তার করলে। আজকে ভারতবর্ষের উত্তর-অংশ তরুবিরল হওয়াতে সে অঞ্চলে গ্রীষ্মের উৎপাত অসহ হয়েছে। অথচ পুরাণপাঠক মাত্রেই জানেন যে, এক কালে এই অঞ্চল ঋষিদের অধ্যুষিত মহারণ্যে পূর্ণ ছিল, উত্তর ভারতের এই অংশ এক সময় ছায়াশীতল সুরম্য বাসস্থান ছিল। মানুষ গৃধ্নুভাবে প্রকৃতির দানকে গ্রহণ করেছে; প্রকৃতির সহজ দানে কুলোয়নি, তাই সে নির্মমভাবে বনকে নির্মূল করেছে। তার ফলে আবার মরুভূমিকে ফিরিয়ে আনবার উদ্যোগ হয়েছে।… মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে অরণ্যসম্পদ্কে রক্ষা করা সর্বত্রই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকাতে বড়ো বড়ো বন ধ্বংস করা হয়েছে; তার ফলে এখন বালু উড়িয়ে আসছে ঝড়, কৃষিক্ষেত্রকে নষ্ট করছে, চাপা দিচ্ছে। বিধাতা পাঠিয়েছিলেন প্রাণকে, চারি দিকে তারই আয়োজন করে রেখেছিলেন- মানুষই নিজের লোভের দ্বারা মরণের উপকরণ জুগিয়েছে। বিধাতার অভিপ্রায়কে লঙ্ঘন করেই মানুষের সমাজে আজ এত অভিসম্পাত।”
সেদিন রবীন্দ্রনাথ যে সংকটের কথা তুলে ধরেছিলেন তার বিস্তার-প্রসার এখন আরও ব্যাপক। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব মানুষ হাড়ে হাড়েই টের পাচ্ছে। নদী, বন ধ্বংস করতে করতে এগিয়ে যাওয়া মানুষের চাকা যে ক্রমশ কর্মফলেই বসে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট। তবে তা রোধে যা যা করণীয়, সেই রূপরেখাটি স্পষ্ট নয়। কেননা পৃথিবীর প্রতি আমাদের মমত্ববোধই তলানিতে এসে ঠেকেছে। ওই ভাষণেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের সংকল্প নির্ধারণ করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ অনুতাপ করবার সময় হয়েছে। আমাদের যা সামান্য শক্তি আছে তাই দিয়ে আমাদের প্রতিবেশে মানুষের কল্যাণকারী বনদেবতার বেদী নির্মাণ করব এই পণ আমরা নিয়েছি।’ দুর্ভাগ্যের বিষয় সেই অনুতাপের সময় যেন আমাদের এখনও আসেনি সেভাবে, ফলে টনকও নড়েনি। প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের জন্য এখনও আইনসভায় বিল পাশ হয়ে যায়, আমরা ব্যস্ত থাকি অন্য বিষয়ে; বন নিশ্চিহ্ন করা আর জলাজমি বোজানো এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে যে, বড় বিপর্যয় না নামলে আমরা সেই অনিষ্টের দিকে তাকাতেই ভুলে যাই। বন্যপ্রাণ নিয়েও আমাদের সামান্যতম অনুভব যেন মিলিয়ে গিয়েছে। আমাদের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকে কচ্ছপের শ্বাসরোধ হয়ে গেলেও, প্লাস্টিক বর্জনে তেমন আগ্রহ বোধ করি না। প্রসঙ্গত চলতি বছরের পৃথিবী-দিবসের আলোচ্য বিষয় এই প্লাস্টিক দূষণই। তবে, তার থেকেও বড় দূষণ সম্ভবত ঘটে গিয়েছে আমাদের মনেই। কার্বন নিসঃরণ হোক বা বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে তাই আমাদের যাবতীয় উদ্বেগ সেমিনারে সেমিনারেই আটকে থাকে। বাস্তব তাকে তেমন স্পর্শ করে না। সর্বংসহা পৃথিবীও একদিন প্রতিরোধ জানান দেয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় এসে তখন মানুষকে বলে যায় যে, বিপদের মাত্রা কতখানি। কিন্তু পরিবেশের সঙ্গে ওই নিবিড় সখ্য যদি না ফেরে, তাহলে পরিত্রাণ নেই। মিলছেও না।
সাগান এই পৃথিবীটাকে চিনিয়ে তাই বলেছিলেন, মহাবিশ্বে ওই তো আমাদের একমাত্র ঘর। আসুন, তাকে একটু আগলে রাখি। সত্যি বলতে, সংকটের এই মুহূর্তে এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও মন্ত্র নেই। সভ্যতাগর্বী মানুষ যেন নিজের অস্তিত্বরক্ষার কারণেই এবার অন্তত বলে উঠতে পারে, ফিরে এসো চাকা- প্রকৃতির কাছে, পরিবেশের কাছে, মা-পৃথিবীর কাছে।