রাদিচে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সবসময়ই তাঁর কবিতার শৈলীর প্রতি বিশেষ যত্ন নিয়েছেন। একজন কবি হিসেবে রাদিচে নিজেও মনে করতেন, কবিতা, কিংবা যে কোনও শিল্পই আসলে সেই যত্ন দাবি করে। না হলে কালের দরবারে সে মূল্য হারায়। সব কারিগরই শিল্পী হবেন, এমনটা আমরা আশা করতে পারি না; তবে সব শিল্পীকে যে কারিগর হতেই হবে, শিল্পীর কাছে এটুকু প্রত্যাশা থাকবেই।
সব কারিগর শিল্পী নন, কিন্তু শিল্পীর কারিগর না হয়ে উপায় নেই। একজন কবি এবং অনুবাদক হিসেবে এমনটাই বিশ্বাস করতেন উইলিয়াম রাদিচে। রবীন্দ্রনাথের লেখাকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার ক্ষেত্রে যেন আলো হাতে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। রবিঠাকুরের নানা সময়ে লেখা নানা কবিতা, তাদের নিজস্ব চারিত্র্যকে বজায় রেখেই তাঁর তরজমায় পৌঁছে গিয়েছিল ইংরেজিভাষী পাঠকমহলে। রাদিচে মনে করতেন, রবীন্দ্রসাহিত্যের এই চারিত্র্যের মধ্যে অন্যতম তার শৈলী। যা অত্যন্ত যত্নের নির্মাণ। অনুবাদের কাজেও সেই যত্ন পুরোপুরি বজায় রেখেছিলেন রাদিচে।
অথচ, রবীন্দ্রসাহিত্যের ইংরেজি ভাষান্তরের কথা বললে যাঁর নাম আজ বলতেই হয়, সেই রাদিচের বাংলা পড়ার নেপথ্যে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না। ছিলেন না মাইকেল কিংবা কোনও অন্য কোনও কালজয়ী বাংলা সাহিত্যিক। রাদিচে নিজেই এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর আগ্রহের নেপথ্যে ছিলেন আপাদমস্তক রাজনৈতিক একজন মানুষ। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। রাদিচের ঠাকুরদা এবং কাকা একসময় অবিভক্ত পূর্ববাংলায় আইসিএস অফিসার হিসেবে কাজ করেছিলেন। সেজন্যেই কি না কে জানে, সে দেশের প্রতি হয়তো একটা টান ছিলই তাঁর। সে টান উসকে দিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। সেই আবহেই বাংলা শিখতে শুরু করেছিলেন রাদিচে।
এখনকার মতো তখনও উত্তাল বাংলাদেশ। সেই সত্তরের দশকের গোড়ায় অক্সফোর্ডে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়া শেষ করেন রাদিচে। রাদিচের মা বেটি রাদিচেও ছিলেন ধ্রুপদী ল্যাটিন সাহিত্যকর্মের বিশিষ্ট অনুবাদক ও সম্পাদক। ফলে তখনও রাদিচে-র ঘনিষ্ঠদের ধারণা মাত্র ছিল না, যে, তিনি কোনও দিন বাংলা শেখায় আগ্রহী হবেন। অক্সফোর্ডে বাংলা পড়ানো হয় না, তাই ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ‘স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ’ বা সোয়্যাস-এ বাংলা পড়তে গেলেন রাদিচে। অধ্যাপক তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের কার্যত মন্ত্রশিষ্য হয়ে যান তিনি। তাঁর মতো মেধাবী ছাত্র পেয়ে মুগ্ধ ছিলেন অধ্যাপকেরাও। পরে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নিয়ে গবেষণা করেন রাদিচে। তর্জমাও করেন ‘দ্য পোয়েম অব দ্য কিলিং অব মেঘনাদ’। তাঁর অনুবাদে ‘দেবতার গ্রাস’ হয় ‘স্ন্যাচড বাই দ্য গডস’, ‘কণিকা’, ‘লিখন’, ‘স্ফুলিঙ্গ’-এর অণুকবিতাগুলি নিয়ে তৈরি হয় ‘পার্টিকলস, জটিংস, স্পার্কস’। গীতাঞ্জলির ইংরেজি ভাষান্তরের মূল পাণ্ডুলিপি এবং ইয়েটসের পরামর্শে তা পরিমার্জনের পর্যায়ে ধাপে ধাপে যে রূপান্তর ঘটেছিল, তা নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন রাদিচে।
অনেক পরে, অধ্যাপক সুজাতা চৌধুরীর স্মরণে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাদিচে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সবসময়ই তাঁর কবিতার শৈলীর প্রতি বিশেষ যত্ন নিয়েছেন। একজন কবি হিসেবে রাদিচে নিজেও মনে করতেন, কবিতা, কিংবা যে কোনও শিল্পই আসলে সেই যত্ন দাবি করে। না হলে কালের দরবারে সে মূল্য হারায়। সব কারিগরই শিল্পী হবেন, এমনটা আমরা আশা করতে পারি না; তবে সব শিল্পীকে যে কারিগর হতেই হবে, শিল্পীর কাছে এটুকু প্রত্যাশা থাকবেই। বোঝাই যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ এবং রাদিচে দুজনেই বিশ্বাস করতেন শিল্পীর পরিশ্রমে। শিল্পী মাত্রেই আত্মভোলা অগোছালো হবেন, তাঁর কাজে থাকবে অযত্নের ছাপ- এই প্রচলিত বিশ্বাসে তাঁরা কেউই আস্থা রাখেননি। এই বোধে দুজনেই থিতু ছিলেন বলেই, তরজমাতেও রবীন্দ্রনাথের লেখার আত্মাকে জিইয়ে রাখতে পেরেছিলেন রাদিচে।
তা বলে কি যা লেখা, তা-ই অনুবাদ করতে হবে? না, তেমনটাও আদৌ করেননি রাদিচে। সে কথা বোঝাতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘মধুর মিলন’ কবিতার। যেখানে ধ্রুবপদের মতো ফিরে ফিরে আসে ‘ওগো মরণ, হে মোর মরণ’ এই শব্দবন্ধ। রাদিচের বক্তব্য ছিল, ইংরেজিতে ‘ও মাই ডেথ’ বললে তা খুব একটা শ্রুতিমধুর হবে না। বরং ‘ডেথ’ শব্দের কাঠিন্য এসে ধাক্কা দেবে শ্রোতার কানে। বদলে ‘ডেথ, ডেথ’- এই সহজ প্রয়োগেই আস্থা রাখেন তিনি। স্তবক জুড়েই এই ধ্রুবপদের চলাচল ঘটান তিনি, যাতে মৃত্যুর আকস্মিক পদধ্বনিটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এমন নিবিড় মনোযোগেই রবীন্দ্রসাহিত্যের অনুধ্যান করে গিয়েছেন উইলিয়াম রাদিচে। বিশেষ করে বিশ শতকের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে যে নতুন করে আগ্রহ জেগে ওঠে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন তার নেপথ্যে রাদিচের ভূমিকা অনেকখানিই। শুধু রবীন্দ্রনাথ-মাইকেল নন, বাঙালি যাকে ঘিরে শিশুপাঠ্যের গণ্ডি টেনে রেখেছে সেই উপেন্দ্রকিশোরকেও তরজমার জগতে টেনে এনেছিলেন রাদিচে। ‘টুনটুনির বই’ তাঁর হাতে হয়ে উঠেছিল ‘দ্য স্টুপিড টাইগার অ্যান্ড আদার টেলস’। ২০০২ সালে ৭৮৪ পাতার বিপুল বই ‘মিথস অ্যান্ড লিজেন্ডস অফ ইন্ডিয়া’ প্রকাশ পায়, যেখানে পি লালের অনূদিত মহাভারত থেকে ১১২টি আখ্যান তুলে এনে তাকে নিজের বয়ানে, নিজের মতো করে সাজিয়েছিলেন রাদিচে। ইংরেজিভাষী বহির্বিশ্বে এভাবেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, তথা ভারতীয় সাহিত্যেরও এক গুরুত্বপূর্ণ দূত হয়ে উঠেছিলেন রাদিচে।