মহাশ্বেতা দেবীর লেখা ‘দ্রৌপদী’ গল্পটিকে মঞ্চে তুলে এনেছিলেন মণিপুরের প্রবাদপ্রতিম নাট্যব্যক্তিত্ব কানহাইয়ালাল ও সাবিত্রী হেইসনাম। নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সাবিত্রী। গল্পে রাষ্ট্রের পুলিশের হাতে ধর্ষিত হওয়ার পর নগ্ন অবস্থায় সামনে আসে সেই মেয়েটি। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তা-ই ছিল তার প্রতিবাদ। এই চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে মঞ্চে নগ্ন হওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন সাবিত্রী নিজেও।
সম্প্রতি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস থেকে বাদ পড়েছে ‘দ্রৌপদী’ গল্পটি। রাষ্ট্রের সামনে সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের রুখে দাঁড়ানোর কথা বলে মহাশ্বেতা দেবীর লেখা এই গল্প। আর এই গল্পকেই মঞ্চে এনেছিলেন কানহাইয়ালাল ও সাবিত্রী হেইসনাম। গল্পের শেষ দৃশ্যে ধর্ষিতা দ্রৌপদী কাপড় পরতে অস্বীকার করেছিল। কোনোরকম যান্ত্রিক সহায়তা ছাড়াই সেই দৃশ্যকে মঞ্চে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সাবিত্রী হেইসনাম। সে দৃশ্য দেখে গায়ে কাঁটা দিয়েছিল উপস্থিত দর্শকের।
আরও শুনুন: সিলেবাস থেকে বাদ মহাশ্বেতা দেবীর গল্প, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তে বিতর্ক
গল্পটা এরকম, জোতদারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলত খেতমজুর দ্রৌপদী তথা দোপদী আর দুলনা। আস্তে আস্তে জোট বাঁধছিল বাকি খেতমজুরেরা। একদিন তিনটে গ্রাম ঘিরে ফেলে গুলি চালাল পুলিশ। সবাই শেষ। মড়ার ভান করে কোনওমতে পালিয়েছিল ওরা দুজন। সাতাশ বছরের দোপদী সেই থেকে ওয়ান্টেড। কিন্তু ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, পালিয়ে আর কতদিন বাঁচা যায়! জল খেতে গিয়ে ধরা পড়ল দুলনা, তারপর গুলি। কিন্তু দোপদী যখন ধরা পড়ল, তাকে অত সহজে রেহাই দিল না পুলিশ। সে যে মেয়ে। তাই অফিসারের নির্দেশে পুলিশরা ‘বানাতে’ লাগল তাকে। অর্থাৎ, নির্দেশ এল গণধর্ষণের। সারা রাত ধরে। সাতজন অব্দি বোধহয় দোপদীর চোখ খোলা ছিল। তারপরে জ্ঞান হারায় সে। পরদিন সকালে অফিসারের ব্রেকফাস্ট টেবলের সামনে এসে দাঁড়াল দোপদী মেঝেন। তখন তার গায়ে একটা সুতোও নেই। তার কাপড় যারা খুলে নিয়েছে, তাকে কাপড় পরানোর অধিকার আর তাদের দেবে না দোপদী।
আরও শুনুন: ‘আপত্তিজনক’ ছবিতে হিন্দু দেব-দেবীর ‘অপমান’, অভিযোগে ‘কামসূত্র’-এ আগুন বজরং দলের সদস্যদের
২০০০ সালে এই প্রযোজনা করেন কানহাইয়ালাল। তার অনেক আগে, ১৯৭২ সালেই মণিপুরে জারি হয়েছে ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট’। মণিপুরের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এই ‘আফস্পা’-র অত্যাচার সয়ে আসছেন। এ নিয়ে তাঁদের অভিযোগও ছিল বিস্তর। এই প্রেক্ষিতেই ‘দ্রৌপদী’ গল্পটিকে বেছে নিয়েছিলেন কানহাইয়ালাল-সাবিত্রী। প্রথম অভিনয়ে শেষের দৃশ্যটিতে সাবিত্রী নিজে নগ্ন হননি, নাটকীয় কৌশলের সাহায্য নিয়েছিলেন। পরে তিনিই বলেন, এ ছাড়া নাটকটি করার কোনো মানে হয় না। নগ্নতা এখানে কাম জাগায় না, বরং প্রবল অস্বস্তিতে ফেলে। ২০০৪ সালের ১৫ জুলাই, মণিপুরের কাংলা দুর্গের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে ধর্ষণের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন মণিপুরের মায়েরা।
সাবিত্রী হেইসনাম এই নাট্যের মধ্যে দিয়ে সেই প্রতিবাদের পথ খুলে দিয়েছিলেন। বলা ভালো, ক্রান্তদর্শী হয়ে এই অত্যাচার আর তার প্রতিবাদের হাতিয়ার তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী-ই। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই গল্পটিই বাদ পড়ল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের সিলেবাস থেকে।
চিত্রঋণ: মণিপুর কলাক্ষেত্র