সুজন দাশগুপ্তের সপ্রতিভ জীবনদর্শনই তাঁর সাহিত্যকীর্তির পরতে পরতে, বাঙালি পাঠক সে লেখায় দেখতে পেত নিজেকে, চিনে নিতে পারত আপন অস্তিত্ব।
আচমকাই ইতি। জীবনের শেষ পাতা যে এমন আকস্মিকতায় ভরা থাকবে, তা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তাঁর অগণিত পাঠক-অনুরাগীরা। একেনবাবুর স্রষ্টা হিসাবেই তিনি পাঠকমহলে বেশি পরিচিত। তবে শুধু একেনবাবুর গল্প নয়; সুজন দাশগুপ্ত এমন একজন সাহিত্যিক, যাঁর রসময় লেখনীর জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত বাঙালি পাঠক। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে আক্ষরিক অর্থেই শোকস্তব্ধ সাহিত্য-জগৎ।
আরও শুনুন: আঁকায়-রেখায় ফুটে ওঠা বাঙালির মঙ্গলকাব্য, অন্য এক পৃথিবী গড়ে দিয়েছিলেন নারায়ণ দেবনাথ
নির্মল কৌতুক। নিখাদ বাঙালিয়ানা। গদ্যের পরতে পরতে মিশে থাকা সরস বাচনভঙ্গি। সুজন দাশগুপ্তের সাহিত্য বাঙালি পাঠককে দিয়েছিল একেবারে স্বতন্ত্র আস্বাদ। আধুনিক জীবনের ভিতর বসেই স্পর্শ করে থাকা চিরায়তকে। অথবা চিরায়তকে স্পর্শ করেই আধুনিকতার অভিমুখী। বলা যায়, এই উভমুখী চলাচলে সুজনবাবু বাঙালি পাঠককে গড়ে দিয়েছিলেন এক আপনগ্রাম। আসলে ছাপোষা বাঙালি জীবনের নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মধ্যেও যে হাসির আলো লুকিয়ে আছে, তাই-ই দ্যুতিময় হয়ে উঠত তাঁর লেখায়। নিছক কৌতুক তা নয়। বরং এক বিশেষ ধরনের জীবনদর্শনও। যে-জীবন আধুনিক বলে আমরা ভেবে থাকি, সেই জীবন অনেকাংশেই আমাদের থেকে কেড়ে নিয়েছে এই আলো-উজ্জ্বল মুহূর্তগুলি। চোখ ফিরিয়ে যা দেখা হয় না, তাই-ই দেখিয়ে দিত তাঁর লেখনী। আর মনে হত, যে জীবন বিস্বাদ বলে ক্লান্ত, তার ভিতরও রসদ লুকিয়ে থাকে বেঁচে থাকার। শুধু তা খুঁজে নিতে জানতে হয়। সুজন দাশগুপ্তের এই সপ্রতিভ জীবনদর্শনই তাঁর সাহিত্যকীর্তির পরতে পরতে, বাঙালি পাঠক সে লেখায় দেখতে পেত নিজেকে, চিনে নিতে পারত আপন অস্তিত্ব।
আরও শুনুন: নীরবে বিদায়ের ইচ্ছা পূরণ হয়নি রবীন্দ্রনাথের, কবির ভাবনা ছুঁয়েই যেন নিঃশব্দে চলে গেলেন শাঁওলি
তাঁর সাহিত্য-দর্শনের এই ঘরানারই সার্থক প্রতিনিধি বলা যায় একেনবাবুকে। এমন একজন ছাপোষা মানুষ যে গোয়েন্দা হয়ে উঠতে পারেন, তা যেন কল্পনাতেও আনা যায় না। গোয়েন্দা মানেই যে অতি-স্মার্ট একটা চরিত্রের ধারণা বাঙালি পাঠকের মনে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে, তাকে প্রায় ওলটপালট করে দিয়েই এল একেনবাবু। বইয়ের পাতা থেকে যখন ওয়েব সিরিজ ও সিনেমার পর্দায় তাকে দেখা গেল, সকলেই যেন মনে মনে বলে উঠলেন, একেন্দ্র সেন, এতদিন কোথায় ছিলেন? ঠিক এখানেই সুজনবাবুর মুনশিয়ানা। বাঙালির মন ও মনন তিনি জানতেন হৃদস্পন্দনের মতোই। আর তাই তাঁর লেখায় বারেবারে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন বাঙালির নিজস্ব ভুবন। তাঁর লেখার সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় অবশ্য শুধু একেনবাবুর পরিধিতে আটকে নেই। যাঁরা তাঁর ‘নিভৃতে’ উপন্যাসটি পড়েছেন, তাঁরা জানেন সুখচিন্তাপুরের সেই ঘটনাবলি বাঙালি জীবনের অমোঘ ছবি। এই জীবন ফড়িং-এর দোয়েলের নয়, বরং বাঙালি একান্ত আপন। কোনও এক সম্মোহনে হয়তো তা ভুলে যেতে বসেছে বাঙালিরা। কৌতুকের প্রাথমিক পর্বটুকু সরে গেলে, বোঝা যায়, সেই হারিয়ে-যাওয়ার আপন ভুবনটিকেই বাঙালির কাছে ফিরিয়ে দেওয়া যেন ছিল সুজনবাবুর পণ। একেনবাবুও এর ব্যতিক্রম নয়। চাকরিসূত্রে দীর্ঘদিন প্রবাসী হওয়ার ফলেই হয়তো তিনি জানতেন, ভুবনগ্রামের মায়া কীভাবে আমাদের স্মৃতি-শিকড়ের সঙ্গে দূরত্ব রচনা করেছে। সুজনবাবুর লেখনী সেই দূরত্ব মুছে দিতে জানত অনায়াসে। স্যাটায়ারের তির্যকতা নয়, তাঁর লেখার অভিমুখ উইটে। বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুকের আলোয়ান চাপিয়ে বাঙালির স্মৃতি-সত্তা সন্ধানেই রত ছিল সুজনবাবুর সাহিত্য। সাহিত্যচর্চার বৃহত্তর ও উন্মুক্ত পরিসরটিকে নিয়ে যত্ন নিয়ে পরিচর্যা করতেন। ‘অবসর’ ওয়েবজিনের সম্পাদনায় মিশে আছে সে ছাপ। তাঁর প্রয়াণ তাই যেমন এক অমায়িক, মিশুকে মানুষের চলে যাওয়া; তেমনই বাঙালির রসময় বুদ্ধিদীপ্ত লেখার ধারাতেও নেমে আসা এক আকস্মিক পূর্ণচ্ছেদ। নতুন লেখার কথা উঠলে বাঙালি পাঠক এবার থেকে মিস করবেন তাঁকে। শুধু একেনবাবুর স্রষ্টাকে নয়, সামগ্রিক ভাবে সুজন দাশগুপ্তকেই।