শাঁওলির গোটা ইচ্ছাপত্রটিই যেন বেজে উঠছে কবির সেই পঙক্তিতে – ‘যাবার দিনে এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই, যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই… । জীবন থেকে মৃত্যুতে, এই পরিক্রমায়, গীতাঞ্জলির এহেন বোধে পৌঁছাতে সকলে পারেন না। পারেন কেউ কেউ। তাঁরা ব্যতিক্রমী। যেমন, শাঁওলি মিত্র। তাঁকে আমাদের প্রণাম।
তিনি চলে গেলেন। সকলের অলক্ষে, নিশ্চুপে। যেভাবে শীতের ছোঁয়া লেগে ঝরে যায় গাছের পাতা। কিংবা বেলাশেষে মাটির বুকে ঝরে পড়ে ফুলের পাপড়ি। তেমনই তাঁর চলে যাওয়া সকলের অগোচরে। এই যে যাওয়া- তা যেন একজন কবির মতোই। অথবা এই শব্দহীন প্রস্থান যেন নিজেই একটি কবিতা। মঞ্চই তাঁর সাধনার ভূমি। সেই কোন শৈশবে মঞ্চে তাঁর প্রবেশ। তারপর জীবনের সিন্দুকে থেকে গিয়েছে মঞ্চে প্রবেশ আর প্রস্থানের কত অগণন স্মৃতি। সমবেত করতালির মধ্যে মঞ্চ ছাড়ার অভিজ্ঞতা তো তাঁর কাছে নতুন কিছু নয়। তবু জীবনমঞ্চ ছাড়ার সময় নৈঃশব্দের অভিবাদন গ্রহণের যে পথখানি বেছে নিলেন শাঁওলি, তা যেন বিস্মিত করে আমাদের কোলাহল-উন্মত্ত সভ্যতাকে।
আরও শুনুন – দেশে প্রথম মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা, লড়াইয়ের অপর নাম সাবিত্রীবাই ফুলে
যখন তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হল, বিমূঢ় বাঙালি যেন খেয়াল করল, ‘সে চলে গেল বলে গেল না’। একটু পরেই অবশ্য বোঝা গেল, বলে যে যাবেন না, সেই কথাটিই তিনি বলে গিয়েছিলেন অনেক আগে। একটি ইচ্ছাপত্র করে জানিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর এবারের প্রস্থান বা চূড়ান্ত প্রস্থান হোক নীরবতার নিবিড় ঐশ্বর্যে। এই মুখর পৃথিবী এমন ইচ্ছের যে মর্যাদা দিতে পেরেছে তাও যেন এক বড় পাওনা।
এই ইচ্ছেই তো প্রকাশ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাবার বেলা যখন সমাগত, তখন কাছের মানুষকে জানিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর শেষ ইচ্ছে। কী সেই ইচ্ছে? নির্মলকুমারী মহলানবিশকে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি আমার সত্যি বন্ধু হও , তাহলে দেখো আমার যেন কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে ‘জয় বিশ্বকবি কি জয়, জয় রবীন্দ্রনাথের জয়, বন্দেমাতরম্’ – এইরকম জয়ধ্বনির মধ্যে সমাপ্তি না ঘটে। আমি যেতে চাই শান্তিনিকেতনের উদার মাঠের মধ্যে উন্মুক্ত আকাশের তলায়, আমার ছেলেমেয়েদের মাঝখানে। সেখানে জয়ধ্বনি থাকবে না, উন্মত্ততা থাকবে না। থাকবে শান্ত স্তব্ধ প্রকৃতির সমাবেশ। প্রকৃতিতে মানুষে মিলে দেবে আমায় শান্তির পাথেয়। আমার দেহ শান্তিনিকেতনের মাটিতে মিশে যাবে- এই আমার আকাঙ্ক্ষা। চিরকাল জপ করেছি ‘শান্তম্’। এখান থেকে বিদায় নেবার আগে যেন সেই ‘শান্তম’ মন্ত্রই সার্থক হয়। কলকাতার উন্মত্ত কোলাহল, জয়ধ্বনির কথা মনে করলে আমার মরতে ইচ্ছে করে না।’ বলেছিলেন বটে। একজন কবির যেভাবে যাওয়া সাজে, সেভাবেই চলে যেতে চেয়েছিলেন। মিশে যেতে চেয়েছিলেন প্রকৃতির শান্ত সমাবেশে। কিন্তু তা আর হয়েছিল কই! বরং উলটোটারই সাক্ষী থেকেছে বিশ্ব। ২২ শ্রাবণ, জনতার উন্মত্ত সমুদ্রে কবি যখন ভাসতে ভাসতে চলেছিলেন, মনে মনে ক্ষমা চেয়েছিলেন নির্মলকুমারী। কবির শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করা তাঁর এবং তাঁদের সাধ্যে কুলোয়নি।
আরও শুনুন – সলিল চৌধুরীর গান গাইতে গিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন কিশোর কুমার, কেন জানেন?
শাঁওলির রেখে যাওয়া ইচ্ছাপত্রেও যেন রবীন্দ্রনাথের শেষ ইচ্ছেরই প্রতিধ্বনি। ভালবাসা তিনি অনেক পেয়েছেন। সেই ভালবাসা তাঁর পাথেয়, যদি মৃত্যুর পরেও কোনও জীবন থাকে, সেই পথেও তাঁকে এগিয়ে দেবে মানুষের ভালোবাসা। এ বিশ্বাসে থিতু থেকেছেন শেষ দিন পর্যন্ত। কিন্তু শেষের ক্ষণে চাননি ফুলভার। শেষবেলার সেই ঋণ কি আর শোধ হবে না, তাই কি এমন নীরব প্রস্থান? নাকি, এই নীরবতাই আসলে এই মুখর কোলাহলের পৃথিবীর বিপ্রতীপে একজন শিল্পীর রেখে যাওয়া শেষ বয়ান। হয়তো তাই-ই। মৃত্যু তো কোনও ‘ইভেন্ট’ নয়। অথচ প্রায়শই বিখ্যাতজনের মৃত্যুকে আমরা সেই রূপ দিয়ে ফেলি। শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের এক ধরনের উন্মত্ততা এসে ঢেকে দেয় মৃত্যুর শান্ত সৌন্দর্য। অথচ চলে যাওয়ার ভিতরও তো এক রকমের আভিজাত্য আছে। প্রিয় মানুষ, প্রিয় শিল্পী, প্রিয়জনের বিচ্ছেদে শোকপ্রকাশের ভিতর যে একাকীর বেদন নিহিত, তা কি সমবেত গানে ধরা পড়ে! নাকি ধরা পড়া সম্ভব! তবু এসবই হতে থাকে। কেবলই মুখর পৃথিবীতে টুকরো দৃশ্যের জন্ম হয়। জন্ম কিংবা মৃত্যু- এই মুখরতা কাউকে যেন রেহাই দেয় না।
অথচ যিনি শিল্পী তিনি চান এক ঐশ্বর্যময় প্রস্থান। মেঘের বুকে সোনালি বিদ্যুতের মতো মিলিয়ে যাওয়া। প্রকৃতির অসীম ঔদার্যের ভিতর মিশে যাওয়া। মৃত্যুতেও কাঙ্ক্ষিত এই যে আভিজাত্য, তা আসলে এক জাতির অর্জন। হয়তো এই সুর বেঁধে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথই। তাঁর ইচ্ছেপূরণ হয়নি। হয়েছিল কিংবদন্তি শম্ভু মিত্রের। তিনিও প্রস্থানের সময় করতালি প্রত্যাশা করেননি। উত্তরসূরি শাঁওলিও তা করলেন না। এই পরম্পরা আসলে চিনিয়ে দেয় একটা জাতির অন্তর্গত মানসিক সৌন্দর্যকে, তার আভিজাত্যকে। শাঁওলির গোটা ইচ্ছাপত্রটিই যেন বেজে উঠছে কবির সেই পঙক্তিতে – ‘যাবার দিনে এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই, যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই…’ । জীবন থেকে মৃত্যুতে, এই পরিক্রমায়, গীতাঞ্জলির এহেন বোধে পৌঁছাতে সকলে পারেন না। পারেন কেউ কেউ। তাঁরা ব্যতিক্রমী। যেমন, শাঁওলি মিত্র। তাঁকে আমাদের প্রণাম।