তাঁরা দুজনেই চলচ্চিত্র জগতের দুই দিকপাল। বাংলা ভাষায় শুধু নয়, ভারতীয় চলচ্চিত্রকেই নতুন দিশা দেখিয়েছিল তাঁদের অন্তর্দৃষ্টি। বিশেষ একটি সিনেমা নিয়ে দুজনের মধ্যে হয়েছিল মতবিরোধ। দুজনেই প্রায় দুজনের ভাবনায় অনড় ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুজনের মধ্যে সৌজন্য হারায়নি বিন্দুমাত্র। এই সংস্কৃতির বাঙালির নিজস্ব। এই ঐতিহ্যেরই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি আমরা। মৃণাল সেনের জন্মদিনে সেই সৌজন্যের দিনকাল ফিরে দেখলেন অর্পণ গুপ্ত।
শ্যাম বেনেগালের সত্যজিৎকে নিয়ে তথ্যচিত্রে তিনি ঋত্বিক আর মৃণাল সম্পর্কে বলেছিলেন ‘দে ওয়্যার মেকিং ফিল্মস ভেরি ডিফারেন্ট ফ্রম মাইন, ভেরি ডিফারেন্ট, বাট ভেরি পাওয়ারফুল, আই থিংক…’। ‘ডিফারেন্ট’ বা ‘ভিন্ন’ শব্দটা তখনও এমন মারমার কাটকাট মেজাজ নিয়ে আসেনি বঙ্গজীবনে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তর্কের যে পরিসর, যা কিনা হালে কেবলই খেউড়ে বদলে যেতে চায়; হেগেলের থিসিস-আন্টিথিসিস-সিন্থেসিস তত্ত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ব্যক্তি আক্রমণই হয়ে পড়ে বিরুদ্ধমতের একমাত্র প্রতিবাদ – সেখান থেকে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে গেলে, ‘নিউ ওয়েভ অফ ইন্ডিয়ান সিনেমা’-র জন্ম লগ্নে (১৯৬০-৭০) এই ভিন্নমতের এক ধরণের পরিশীলিত প্রকাশ আমরা দেখতে পেতাম বিভিন্ন ক্ষেত্রে। শিক্ষিত বাঙালি মননের ঠোকাঠুকি সেখানে আলো আলো করে দিত শিল্পমাধ্যমের নতুন দিগন্তকে। সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন, বাংলা চলচ্চিত্রের দুই ধারার দুই কিংবদন্তি পরিচালকের এহেন তরজা ছয় ও সাতের দশকে হইহই ফেলে দিত চলচ্চিত্র মহলে।
আরও শুনুন: দুর্ভাগা সে দেশ… সম্প্রীতির প্রয়োজনে শিল্পীর বন্ধুতাও যেখানে মাপা হয় ধর্মের পরিচয়ে
১৯৬৫ সালে মুক্তি পেল মৃণাল সেনের ‘আকাশ কুসুম’। রিলিজের পরেই গল্পের প্রোটাগনিস্ট অজয়ের চরিত্র বুনন নিয়ে দর্শক ও ফিল্ম ক্রিটিকদের মধ্যে দেখা দিল মতানৈক্য। সময়ের টানাপড়েনে একই চরিত্রের যে ভিন্ন রং ফুটে ওঠে একটি চলচ্চিত্রে, তার প্রতিটি বিন্দু জুড়েই যদি চরিত্রের সামগ্রিক নির্মাণ বলে ধরা হয় সেক্ষেত্রে অজয়ের চরিত্র আদতে নায়ক চরিত্র হতে পারে কি? চিঠিচাপাটিতে উত্তাল হল বাংলা চলচ্চিত্র মহল। বিষয়টা এমন জায়গায় গেল যে একটি বিজ্ঞাপন দিয়ে বলতে হল – ‘অজয় চিটিংবাজ নয়, সে উচ্চাকাঙ্ক্ষী’। স্টেটসম্যান পত্রিকায় কাহিনীকার আশিষ বর্মণ ও পরিচালক মৃণাল সেনকে উদ্দেশ্য করে আসতে শুরু করল একের পর এক চিঠি। এরই মাঝে টেলিফোন বেজে ওঠে মৃণাল সেনের বাড়িতে। ফোনের ওপারের ব্যারিটোন ভয়েস চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় তাঁর। সত্যজিৎ রায়, যিনি বন্ধু মৃণালকে টেলিফোন করে জানালেন কাহিনীকার আশিষ বর্মণের সঙ্গে স্টেটসম্যান পত্রিকায় চিঠি-চালাচালিতে তিনিও যুক্ত হতে চান এবং মৃণাল যেন তাঁর সমালোচনাকে গঠনমূলকভাবেই নেয়, সত্যজিতের এই প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করেন মৃণাল। শুরু হল সেই মহাবিতর্কিত চিঠি-তরজা। ‘দ্য স্টেটসম্যান’ দৈনিকে দু’মাস ধরে চলল সত্যজিত-মৃণাল-বর্মণ চিঠি চাপাটির ত্রিমুখী যুদ্ধ। বিষয়টা এমন জায়গায় গেল যে সম্পাদক বাধ্য হয়ে ঘোষণা করলেন, ‘আর নয়’; সেদিন সত্যজিৎ মজা করে বললেন, ‘আমার ব্যাগ-এ আরও অনেক শব্দ ছিল।’ মৃণালের জবাব- ‘আমারও ছিল, ট্রাক ভর্তি, যদিও আপনি আমার চাইতে ঢের বেশি বুদ্ধিমান।’ তৃতীয় ভুবন-এ মৃণাল সেন জানান সেই মুহূর্তে তাঁর বোধ করি মনে আসছিল বিখ্যাত বিজ্ঞানীর সেই অমোঘ উক্তি- ‘ট্রুথ অ্যাটেনস আ কোয়ালিটি ওনলি হোয়েন ইট বিকামস কন্ট্রোভার্সিয়াল।’’ বিতর্ক বলে বিতর্ক! ডার্ক হিউমরে ঠাসা চিঠির শেষে সত্যজিতের সেই বিখ্যাত কথা- “আ ক্রো ফিল্ম, ইজ আ ক্রো ফিল্ম, ইজ আ ক্রো ফিল্ম”
আরও শুনুন: ধর্মপরিচয় প্রধান নয়, তিনি বাঙালি… স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন বাঙালির আইকন সত্যজিৎ
আকাশ কুসুম-এর পর এই মৃণাল-সত্যজিতীয় কিসসা কি প্রভাব ফেলেছিল মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র ভাবনায়? ‘ভুবন সোম’ বা ‘ইন্টারভিউ’তে মৃণাল ভেঙে ফেলছেন ছবির রিয়ালিস্টিক কাঠামো, কলকাতা ট্রিলজিতে কলকাতা-সহ সারা বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে মৃণাল সেনের ছবির ইডিয়ম। যে সময়ে সত্যজিৎ ‘হীরক রাজার দেশে’ বানাচ্ছেন, যে সময়ে ঋত্বিকের ছবিতে দেশভাগের ক্ষত হয়ে উঠছে মুখ্য বিষয়, সেই সময়ে মৃণাল প্রকৃত অর্থেই তাঁর কাজে রেখে গিয়েছেন নাগরিকতার ছাপ। আকাশ কুসুম-এর পর মৃণাল সেন যখন ‘ভুবন সোম’ বানাচ্ছেন তখন নিজের কাজ প্রসঙ্গে নিজেই বলছেন ‘দিস ইজ দ্যা বিগিনিং অফ দ্যা নিউ ফেজ’।
আরও শুনুন: পাশে পাননি কাউকে, স্বদেশবাসীর উপর অত্যাচারের প্রতিবাদ একাই করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
যেমন সত্যজিতের ‘প্রতিদ্বন্দী’, ‘জন অরণ্য’, ‘সীমাবদ্ধ’কে ক্রিটিকের দৃষ্টিতে দেখেছেন মৃণাল সেন, তেমনই পুত্র কুণাল সেনের মা গীতা সেনকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটি চিঠির প্রসঙ্গ তুলে নিয়ে আসছেন, যেখানে প্রকাশ পাচ্ছে ‘অপরাজিত’ নিয়ে মৃণালের মুগ্ধতা। তাঁর ছবির রাজনৈতিক অবস্থান সুস্পষ্ট, সেন্স অব হিউমার, মার্জিত রসবোধ পেরিয়ে মৃণাল সেনের ছবিতে থেকে গেছে ছিল এক বিস্ময়বোধ। ভুবনসোম সিনেমায় আমরা সাম্রাজ্যবাদ-উত্তরভারতীয় সমাজের একটি স্থিরচিত্র পাই, সত্যজিতের সিনেমা-ভাবনা তাই মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ নিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে মুগ্ধতা!
সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন সমসাময়িক হওয়ায় আমাদের সামনে থেকে গেছে বেশ কিছু শিক্ষিত তরজার আখর, যা শেষ হয়েছে সৌজন্যে ও বন্ধুতায়। যেখানে দুই প্রথিতযশা পরিচালকের কথোপকথন প্রভাবিত করেছে সামগ্রিক চলচ্চিত্র ভাবনাকে। এর পরেও তাঁরা সম্মিলিত ভাবে বিভিন্ন প্রয়াসে শামিল হয়েছেন। ব্যক্তিমতের পার্থক্য, শিল্পবোধের পার্থক্য কোথাও মলিন করেনি সৌজন্য এবং ভালোবাসার আকাশ।
আজকের এই অসহিষ্ণু সমাজে, সত্যজিৎ-মৃণাল এই মহার্ঘ শিক্ষাটুকু দিয়ে গেছেন। আমাদের কাজ তাঁকে যত্নে গ্রহণ করা।…