তিনি লিখেছিলেন, ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব/ জাত জালিয়াত খেলছে জুয়া।/ ছুঁলেই তোর জাত যাবে?/ জাত ছেলের হাতের নয়কো মোয়া।’ ধর্মের আস্ফালন যেখানে মানুষকে পীড়িত করেছে, সেখানে বরাবরই ধর্মের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন এই কবি, যাঁর নাম কাজী নজরুল ইসলাম। কিন্তু ১২৫তম জন্মদিনের আগে সেই ধর্মের কারণেই অপমানিত হতে হল বিদ্রোহী কবিকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ঘটনার কথা জানিয়ে প্রতিবাদে সরব হলেন সাহিত্যিক বিনোদ ঘোষাল। কী ঘটেছে ঠিক? শুনে নেওয়া যাক।
১৯২৩ সালের ২৩ মে। জেলখানায় উনচল্লিশ দিন একটানা অনশন করার পর সেই তারিখে অনশন ভঙ্গ করেছিলেন বাংলার এক তরুণ। না, কোনও ব্যক্তিগত অপরাধ করে তিনি জেলে যাননি। তাঁর অপরাধ ছিল সে সময়ের ব্রিটিশ শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা। তার জেরেই এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল সেই তরুণের। কিন্তু কারাদণ্ড দিয়েও তাঁর প্রতিবাদী স্বরটিকে দমিয়ে রাখা যায়নি। হুগলি জেলে রাজবন্দিদের ওপর জেলসুপারের অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই একটানা উনচল্লিশ দিন অনশন করেছিলেন তিনি। যাঁর নাম কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবির ১২৫তম জন্মদিনের ঠিক আগে আগেই এ কথা মনে করালেন সাহিত্যিক বিনোদ ঘোষাল। শুধুমাত্র শ্রদ্ধা জানাতে নয়, বরং তিনিও প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবেই তুলে ধরেছেন সেই ঘটনাটিকে। উনিশ শতকের বাংলায় যে একদল উজ্জ্বল মনীষার দেখা মিলেছিল, যাঁরা প্রতিভার আলো ছড়ানোর পাশাপাশি মানুষ হওয়ারও পাঠ দিয়ে গিয়েছিলেন, কবি নজরুল তাঁদের অন্যতম। কিন্তু যে মানুষটি এই ভাষা, এই দেশের গর্ব, এত বছর পেরিয়ে তাঁর দিকেই অপমান ছুড়ে দিতে দ্বিধা করছে না তাঁর দেশ। তাও নিছক ধর্মপরিচয়ের জন্য। সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া তেমনই একটি ঘটনার কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়ে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন সাহিত্যিক বিনোদ ঘোষাল।
কী ঘটেছে ঠিক?
আরও শুনুন: ছদ্মনামে আত্মগোপন, মৌলবাদী ফতোয়ায় অন্তত ৫৬ বার বাড়ি বদল করেছিলেন রুশদি
বিনোদ ঘোষাল জানিয়েছেন, সম্প্রতি রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী পালন করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন এক নাচের স্কুলের কর্তৃপক্ষ। গরমের কথা ভেবে গঙ্গার ধারের এক নাটমন্দিরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তার আগে মন্দির কর্তৃপক্ষের থেকে অনুমতিও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরুর আগে জায়গাটি সাজাতে গিয়েই বিপত্তি। তিনি লিখেছেন, “অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা যখন রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের ছবিসম্বলিত ফ্লেক্স টাঙাচ্ছেন তখন সেই মন্দিরের কর্তৃপক্ষ আপত্তি জানালেন, কাজী নজরুল ইসলামের কোনও ফটো ‘পবিত্র মন্দিরপ্রাঙ্গণে’ রাখা যাবে না। সেই অ্যাকাডেমিও নিজেদের সংস্কৃতিমান প্রমাণে মরিয়া হয়ে নজরুল ইসলামের ফটো এবং ফ্লেক্স ছাড়াই সেই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন।” আর এই ঘটনা ঘটেছে যেখানে, তাও বাংলার আরেক সংস্কৃতির পীঠস্থান। যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন চৈতন্যদেব, যিনি মানবপ্রেমের বন্যায় জাতি-ধর্মের সব বিভেদ মুছে দিতেই চেয়েছিলেন। ওই মন্দির কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের দিকেও বিনোদ ঘোষাল প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, “যে রবীন্দ্রনাথ আজীবন নজরুল ইসলামকে নিজের পুত্রবৎ স্নেহ করেছেন, যে রবিঠাকুর বলেছেন অন্যায়কারী এবং অন্যায়সহনকারী উভয়েই সমান অপরাধী, আপনারা রবীন্দ্রনাথের ফটো রেখে রবীন্দ্রসন্ধ্যা পালন করে কী প্রমাণ করলেন?” আজও গড়পরতা বাঙালি অসাম্প্রদায়িক, জাতপাত পেরিয়ে মানবতাই সেখানে বেশি কাঙ্ক্ষিত, এমনটাই মনে করেন অনেকেই। কিন্তু বাঙালির সেই পরিচয়ও এই আচরণে মুছে যাচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি।
আরও শুনুন: মণিপুর থেকে কান… কেন নগ্নতাকেই প্রতিবাদের হাতিয়ার করে তোলেন নারীরা?
‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় নজরুল নিজেই ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন, কট্টর হিন্দুরা তাঁকে ‘নেড়ে’ বলে আক্রমণ করে, আর গোঁড়া মুসলিমরা তাঁকে বলে ‘কাফের’। তাঁর জীবদ্দশায় বারেবারেই ধর্মের ধ্বজাধারীদের আক্রমণের মুখে পড়েছেন নজরুল। কিন্তু ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে তিনি কোনও দিনই গুরুত্ব দেননি। অথচ এত বছর পরেও সেই পরিচয়ই যে বাধা হয়ে উঠল তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর ক্ষেত্রে, তা দেখে হতবাক হতে হয়। ঘটনার প্রতিবাদে বিনোদ ঘোষালের সুরে সুর মিলিয়েছেন শ্রীজাত, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, যশোধরা রায়চৌধুরী-র মতো খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিকও। তবে এই প্রতিবাদের একরকম ফল মিলেছে শেষমেশ। শেষ পর্যন্ত ঘটনায় ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ।